বহির্বিশ্বের সবাই মিলে বাংলাদেশের জনসাধারণকে রক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে

নূর খান লিটন এবং মানবাধিকার কর্মী। তিনি বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছেন। তিনি বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের সমালোচনা এবং তদন্তের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। এসব কারণে বিভিন্ন সময়ে তাকে চাপে রাখা হয়।  

চলতি বছর মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার অ্যাওয়ার্ড’ পান নূর খান লিটন। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে কথা বলেছেন বাংলা আউটলুকের সঙ্গে।

বাংলা আউটলুক: র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দৃশ্যমান ভাবে কমেছে, কিন্তু সার্বিকভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতির কি উন্নতি হয়েছে?

নূর খান লিটন: একটা জিনিস লক্ষণীয় বাংলাদেশের ওপর যখন চাপ আসে বিভিন্ন সময়, জনসাধারণ কথা বলতে শুরু করে; তখন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সংযত আচরণ করে। গুম, বিনা বিচারে হত্যার ঘটনা কমে যায়। কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখেছি বিনা বিচারে হত্যা কমে এসেছিল। কিছুদিন পর আবার বেড়ে যায়। পরবর্তীতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসলে গুম, বিনা বিচারে হত্যা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে হত্যার ঘটনা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল। কিন্তু সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনা আমরা আবার লক্ষ্য করছি। বিশেষ করে পিটিয়ে মারার ঘটনা আমরা দেখছি। নম্বরবিহীন সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। ফলে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে গুম ও বিনা বিচারে হত্যা আবার ফিরে এসেছে।

বাংলা আউটলুক : মানবাধিকার কর্মীদের জন্য নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। আদিলুর রহমান খান, নাসির উদ্দিন এলান, নূর খান লিটনদের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে। এ অভিজ্ঞতাগুলো কি বলে?

নূর খান লিটন:  দেশে ও দেশের বাইরে উভয় জায়গাতেই এক ধরনের ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। দেশের মানবাধিকার কর্মীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এমনকি দেশের বাইরেও তাদের ওপর হামলার চেষ্টা হচ্ছে। হেনস্তা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আদিলুর রহমানের ঘটনাই উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি জেনেভায় গিয়েছিলেন জাতিসংঘের বৈঠকে যোগ দিতে। এরপর তিনি একটি বাইরের অনুষ্ঠানে গেলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে হেনস্তার চেষ্টা করে। তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেওয়া হয়। আরেকটি জিনিস বলতে হবে, এটা হচ্ছে মানবাধিকার সংস্থা বা সংগঠনগুলো বিদেশি সাহায্যনির্ভর। এরা বিভিন্ন দেশে থেকে যে অনুদান পায় তা এনজিও ব্যুরো থেকে ছাড় করাতে হয়। বর্তমানে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অর্থ ছাড় দিচ্ছে না এনজিও ব্যুরো বা নানা ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করছে। ফলে মানবাধিকার সংগঠন তহবিল সংকটেও ভুগতে শুরু করছে। সরকার দুইভাবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোতে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। প্রথমত ভয় দেখিয়ে, দ্বিতীয়ত তহবিল আটকে দিয়ে আর্থিক সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে।

বাংলা আউটলুক: বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা কেন আগের মতো সাহসী ভূমিকা নিতে পারছে না? তাদের মধ্যে কি কোনো বিভাজন কাজ করছে?

নূর খান লিটন: মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নানাভাবেই কাজ করছে। কিন্তু সরকার তাদের কাজের জায়গা সংকুচিত করে ফেলছে। হামলা ও মামলা দিয়ে তাদের আটকে ফেলার চেষ্টা করছে। আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিন এলানকে সাজা দেওয়া হয়েছে। ফলে মানবাধিকার কর্মীরা অবাধে কাজ করতে পারছেন না। আর মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে যে বিভাজন  নেই এই কথা অস্বীকার করা যাবে না।

বাংলা আউটলুক: বাইরের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশ বিষয়ে অব্যাহত ভাবে কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশের প্রায় সব বিষয় নিয়ে তারা কথা বলছে। কিন্তু এর কার্যকর ফল আমরা পাচ্ছি না কেন?

নূর খান লিটন:  দেশের মানুষের সবার দাবি হচ্ছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। সবাই কিন্তু একই কথা বলছে। আমাদের দেশের এখন  কিন্তু সেই পরিবেশ নেই। বরং এখানে ফ্যাসিবাদ গেঁড়ে বসেছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই কিন্তু সহজ না। জনগণের মধ্য থেকে গণ-আন্দোলন গড়ে না উঠলে মানবাধিকার সংগঠন বলেন আর রাজনৈতিক দল বলেন, কারো পক্ষে এককভাবে সফল হওয়া সম্ভব না। সবাই এক হয়ে এ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে। কথা বলতে হবে। এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিয়মিতই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ থাকায় কাজ হচ্ছে না। আমাদের  তো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। কোথাও গণতন্ত্র না থাকলে মানবাধিকার থাকার প্রশ্নই আসে না। আমাদের আগে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাংলা আউটলুক: বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমলেও প্রকাশ্য জনসভায় গুলি করে হত্যা, মিছিলে গুলি, তুলে নিয়ে যাওয়া, জেলখানায় মৃত্যু এগুলো ঘটেই চলেছে। এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

নূর খান লিটন: যেটা আগেই বললাম গুম, বিনা বিচারে হত্যার পাশাপাশি নতুন করে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা আমরা দেখছি। সাদা মাইক্রোতে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অনেকে এগুলোতে দুর্বৃত্তদের ঘটনা উল্লেখ করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্তত দুইটি হত্যার ঘটনায় পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া ধরে নিয়ে গুম করে রাখা হচ্ছে। তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ১০/১৫ দিন পর থানায় হস্তান্তর করা হচ্ছে বা আদালতে তোলা হচ্ছে। এটা সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এবং নতুন করে গুম ফিরে আসার ইঙ্গিত দেয়। এভাবে কাউকে আটকে রাখতে পারে না। জেলাখানার মৃত্যুর বিষয়েও দায়িত্বশীলদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। 

বাংলা আউটলুক: সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য কী করা উচিত বলে আপনারা পরামর্শ দেন?

নূর খান লিটন:  আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশের ভেতরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশের বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো সক্রিয় হতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথেষ্ট কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু আরো শক্তভাবে চাপ দিতে হবে।

বাংলা আউটলুক: এ ক্ষেত্রে কি নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে?

নূর খান লিটন: যে কোনো কিছু হতে পারে। নিষেধাজ্ঞাও হতে পারে। আবার নতুন কিছু হতে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিয়মনীতি মেনে কত কিছুই তো হয়।  মোদ্দা কথা হচ্ছে বহির্বিশ্বের সবাই মিলে বাংলাদেশের জনসাধারণকে রক্ষার জন্য উদ্যোগী হতে হবে।

বাংলা আউটলুক: আপনাকে বাংলা আউটলুকের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ

নূর খান লিটন: আপনাকেও ধন্যবাদ।