জনগণের হাতে সরকারকে জবাবদিহি করার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই

মানবাধিকার কর্মী সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউএস-এ বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজ করছেন। পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউভার্সিটি অব উইসকন্সিনে ডক্টরাল গবেষক হিসাবে কর্মরত। অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়ার গবেষক হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়ার বিস্তারিত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন বাংলা আউটলুকের সঙ্গে। 

বাংলা আউটলুক :  র্যাবের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা দৃশ্যমানভাবে কমেছে, কিন্তু সার্বিকভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতির কি উন্নতি হয়েছে?

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া : এটি সত্য যে র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে হত্যা এবং গুমের মত নৃশংস মানবতা বিরোধী অপরাধ হ্রাস পেয়েছে। এটি একই সাথে স্বস্তিকর আবার দুর্ভাগ্যজনকও। কারণ, এটি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দীর্ঘদিনের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করে যে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে এবং এটি কমাতে বিদেশী হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছে।

আশংকার কথা হচ্ছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গুম-বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলো আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। রহস্যজনকভাবে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জেলের বাইরে ও জেলখানায় খুন হচ্ছেন। আমি মনে করি, এসব অপরাধের ধরন কিছুটা পরিবর্তন হলেও মাত্রাভেদে এগুলো ঘটে চলছে। এছাড়া কিছু কিছু অধিকারের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির বরং উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে। যেমন, মতপ্রকাশের অধিকার, সভা-সমাবেশের অধিকার, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার এগুলোর সুস্পষ্টই অবনতি হয়েছে। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বেড়ে যাওয়া ও বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয়। উদাহরণস্বরূপ, কেবল ২৮ অক্টোবর ২০২৩ পরবর্তী সপ্তাহগুলোর ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করলেই দেখা যাবে হাজার-হাজার (পত্রিকান্তরে, ২০ হাজারেরও বেশি) বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ঠুনকো অজুহাতে, তথাকথিত গায়েবী মামলায় গ্রেফতার ও বিনা-বিচারে আটক রাখা হয়েছে। বিচার বিভাগ এক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ নাগরিকদের কোনো পরিত্রাণ তো দিতে পারেইনি বরং তাদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে বিচারের নামে প্রহসন মঞ্চস্থ করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে যেখানে বাদী ও সাক্ষী উভয়ই পুলিশ। তাড়াহুড়ো করে প্রদান করা এই বিচারিক রায়গুলোর বরাতে আমরা জেনেছি যে, পুলিশ ইতোমধ্যেই মৃত কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে অপরাধ সংঘটন করতে ‘দেখেছে’ এবং বিচারকগণও সেটি বিশ্বাস করেছেন (!) এবং কবরবাসী এসব মানুষদের দণ্ডও দেওয়া হয়েছে। এটি কেবল অস্বাভাবিকই নয়, অবিশ্বাস্যও। সরকার এখন কীভাবে এই কবরবাসী দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের শাস্তি নিশ্চিত করে সেটি আগ্রহভরে দেখতে হবে। এর বাইরে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি এসব কারণে জীবন মানের অবনতি ঘটছে।

বাংলা আউটলুক :  মানবাধিকার কর্মীদের জন্য নানান রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। আদিলুর রহমান খান, এএসএম নাসির উদ্দিন এলান, নুর খান লিটনদের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে। এ অভিজ্ঞতাগুলো কী বলে?

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া : দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে সরকার মানবাধিকার কর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে আইনী ও আইন-বহির্ভুত নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। যেমন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ যা এখন সাইবার সুরক্ষা আইন (২০২৩) নামে পরিচিত, এবং বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৬ প্রভৃতি আইনকে মানবাধিকার সংগঠনের কার্যক্রম অযাচিতভাবে নিয়ন্ত্রণে ও মানবাধিকার কর্মীদের পেশাগত ঝুঁকি তৈরির কাজে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আরও ভয়ের দিক হলো সরকারি বিভিন্ন সংস্থার আইন-বহির্ভূত বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চর করা হচ্ছে। যেমন, গুম, শারীরিক আক্রমণ বা আক্রমণের হুমকি, নজরদারি, বেআইনী আটক প্রভৃতি। আমি বলবো, মানবাধিকার কর্মীরা দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির বাইরে নন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এবং মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান ও এএসএম নাসির উদ্দিনকে সরকার যেভাবে হেনস্তা করেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কেবল মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশে এর আগে কেউ জেল খেটেছে বলে এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত নেই। জনাব নুর খান লিটনের ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞতা একই। তাঁকে জেলে যেতে হয়নি, কিন্তু তিনি বিভিন্ন সময় নজরদারির আওতায় ছিলেন এবং নানা ধরনের হুমকি মোকাবেলা করে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

বাংলা আউটলুক : বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমলেও প্রকাশ্য জনসভায় গুলি করে হত্যা, মিছিলে গুলি, তুলে নিয়ে যাওয়া, জেলখানায় মৃত্যু এগুলো ঘটেই চলেছে। এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া : যেকোনো সভ্য ব্যবস্থায় এ ধরনের নৃশংস ঘটনার পরিত্রাণ হতো প্রাতিষ্ঠানিক। অর্থাৎ কিছু ব্যক্তি এসব অপরাধে জড়িত হলেও রাষ্ট্রের কিছু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থাকতো নাগরিকদের এসব অভিযোগের সঠিক অনুসন্ধান এবং ন্যায় বিচারের বন্দোবস্ত করার জন্য। দৃশ্যত বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ এই প্রাতিষ্ঠানিক পরিত্রাণ পাচ্ছেন না। একটি কার্যকর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো সরকারি/স্ট্যাটিউরি প্রতিষ্ঠান নিজ দায়িত্বপালনে ব্যর্থ হলে সেটির জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে সাংবিধানিক কিছু প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করার কথা, যেমন, মানবাধিকার কমিশন, ন্যায়পাল কমিশন (যেটি বাংলাদেশে নেই)। আমি নিশ্চিত নই, বাংলাদেশের কেউ দাবি করবে যে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ‘কাজ’ করছে। সুতরাং এখানে সমস্যাটা বেশ গভীর। আমি মনে করি, এই বিস্তৃত সমস্যা সমাধানে প্রথমত রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি এ ধারণা পোষণ না করেন যে তাঁরা নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ, তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিপথে যেতে কিংবা আপোষ করতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত, একটি মোটামুটি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার ব্যবস্থা। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর জনগণের ভোটের মুখাপেক্ষী হতে হয় বলে তাদের এক ধরনের জবাবদিহিতার মধ্যে থাকতে হয়। এটিকে ডেমোক্রেটিক একাউন্টেবিলিটি বা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা বলে। দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা কাঠামোটিও ভেঙে পড়েছে। জনগণের হাতে সরকারকে জবাবদিহি করার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই।

বাংলা আউটলুক : বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা কেন আগের মতো সাহসী ভূমিকা নিতে পারছে না? তাদের মধ্যে কি কোন বিভাজন কাজ করছে?

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া : যেকোনো নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করার কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জের। এজন্য মানবাধিকার কর্মীদের নানা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আদিলুর ও এলান মাত্রই জেল থেকে বের হয়েছেন। এর আগে অনেক সাংবাদিক গুম হয়েছেন, মাসের পর মাস জেল খেটেছেন। এগুলো সমাজে এক ধরনের বার্তা দেয়। মানবাধিকার রক্ষার জন্য কারো রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, জেল-জরিমানা, গুম-খুনের শিকার হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রে এগুলো সবই বাস্তব। এই প্রবল ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকারের চ্যালেঞ্জ কেউ নিতে না চাওয়ার নানা ব্যক্তিগত ও পেশাগত কারণ থাকতে পারে। এসবকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না বা এগুলো অন্যায্যও নয়। তারপরও, বাংলাদেশের বহু মানুষ এই ভয়ের শৃঙ্খল ভাঙতে সচেষ্ট রয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করছেন। এসব সাহসী মানুষদের কারণেই আমি আশাবাদী। হ্যাঁ, একটা পক্ষ রয়েছে যারা এই নিপীড়নবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুবিধাভোগী পক্ষ। সত্যিকারের মানবাধিকার কর্মীদের কার্যক্রম সরকার ভেদে ভিন্ন হতে পারে না। যারা এটি করেন, তারা কায়েমী স্বার্থবাদী। তাদের অতীত ভূমিকা যাই হোক, বর্তমানে তাদেরকে আমি মানবাধিকার কর্মী বলতে রাজী নই। সুতরাং, মানবাধিকার কর্মীদের মাঝে কোন বিভাজন নেই। বাংলাদেশের মানুষ বরং চিনতে শিখছে কারা তাদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার এবং কারা নিপীড়কদের সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ।

বাংলা আউটলুক : দেশের বাইরের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশ বিষয়ে অব্যাহতভাবে কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশের প্রায় সব বিষয় নিয়ে তারা কথা বলছে। কিন্তু এর কার্যকর ফল আমরা পাচ্ছি না। কেন?

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া : মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাজ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোকে সঠিকভাবে লিপিবব্ধ করা, অনুসন্ধান করা, প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সেগুলো তুলে ধরা, ন্যায় বিচারের পক্ষে জনমত তৈরি করা বা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। কিন্তু দিন শেষে তারা তো বিচারিক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। কিংবা তাদের এ ধরনের রাষ্ট্রীয় বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় কোনো ম্যান্ডেটও নেই। সুতরাং, মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সে আলোকে বিচার-বিবেচনা করতে হবে। আমি তো মনে করি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা তাদের কাজে সফল। দেশে ও দেশের বাইরে বহু মানুষ এখন জানে বাংলাদেশে কী হচ্ছে। দ্বিরাষ্ট্রীয় ও বহুপাক্ষিক কিছু চাপও তৈরি হয়েছে। কিছু ফলও আমরা পেয়েছি (গুম ও বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড হ্রাস পাওয়া)। প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কোনো রাষ্ট্রে বা সমাজে সার্বিক ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে কিনা। আগে যেমনটি বলেছি, এটি নির্ভর করবে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা কাঠামোর ওপর। কোনো রাষ্ট্রের সরকার বা শাসক যদি মানবাধিকারের প্রতি কোনো অঙ্গীকার না রাখেন এবং তিনি বা তারা যদি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকেন, সেখানে সার্বিক কার্যকর ফল পাওয়া দুষ্কর। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক পরিত্রাণও একটা বিকল্প হতে পারে। যেমন, জাতিসংঘ, আইসিসি প্রভৃতি সংস্থা একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে যদি সত্যিকারের সদিচ্ছা থাকে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী এসব সংস্থাকে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো অবহিত করছে। কিন্তু তারা কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে সেটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বিভাজনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যা এসব সংস্থাকে প্রায় অকার্যকর করে রেখেছে। নিঃসন্দেহে এগুলো কোনো সুখকর বাস্তবতা নয়। তবে এই অকার্যকরতা কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই সত্য তা নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই আমরা প্রতিনিয়ত এ ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি হই।

বাংলা আউটলুক :   সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য কী করা উচিত বলে আপনারা পরামর্শ দেন?

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া :  নাগরিক পর্যায়ে আরও বেশি বেশি নাগরিক উদ্যোগ দরকার। জনসচেতনতা তৈরি, মানবাধিকার পাঠ ও সুরক্ষাকে শিক্ষা কার্যক্রম আবশ্যক করা দরকার। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতদের মানবাধিকার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রোটোকল থাকা আবশ্যক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে, বিশেষ করে বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি স্বাধীন হিসেবে গড়ে তুলে তাদের নৈর্বক্তিকভাবে কাজের চর্চা গড়ে তোলা আবশ্যক। সাংবিধানিক সুরক্ষাগুলোকে আইনী সুরক্ষায় পরিণত করা দরকার। মানবাধিকার রক্ষা ও লংঘনে পুরস্কার ও শাস্তি উভয়টি চালু করা দরকার। তবে, সার্বিকভাবে আমি মনে করি মানবাধিকার ওতপ্রোতভাবে একটি রাজনৈতিক ধারণা এবং রাজনীতিবিদদের সুস্পষ্ট উপলব্ধি ও অঙ্গীকার ছাড়া ব্যাপক আঙ্গিকে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন কঠিন। প্রথমত মনে করতে হবে, মানবাধিকার অবশ্যই কোন বিদেশী ধারণা নয়। একটা দেশের নাগরিকদের স্ব-স্ব অধিকার চর্চার ব্যবস্থা করতে পারা রাজনীতিকদের জন্য কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হওয়া উচিত। জনগণ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার মধ্যে ক্ষমতার একটা প্রবল ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। এটি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্পূর্ত কোনো ব্যাপার নয়। বরং রাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে জনগণই নিজেদের মধ্যকার সামাজিক চুক্তিবলে কিছু প্রতিষ্ঠানকে কিছু ক্ষমতা অর্পণ করেছে যাতে জনগণের যূথস্বার্থ সংরক্ষিত হয়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ জনগণের সার্বিক স্বার্থকে ব্যাহত না করে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে। বাংলাদেশর জনগণও ১৯৭১ সালে এরূপ একটা সামাজিক চুক্তি করেছিল, যাকে আমরা “সংবিধান” বলি। এটি জনগণের অভিপ্রায়ের দলিল যে আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার কথা। এই দলিলের আলোকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো তাদেরকে প্রদত্ত ম্যান্ডেটের মধ্যে থেকে জনগণের সার্বিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা। এর ব্যত্যয় হলে বুঝতে হবে যে, যে অভিপ্রায় নিয়ে জনগণ এই বন্দোবস্ত/সামাজিক-চুক্তি (সংবিধান) তৈরি করেছিলো, যেসব সংস্থা/প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল এবং তাদেরকে যেসব ক্ষমতা দিয়েছিল- সেই বন্দোবস্তটি আর কাজ করছে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একটি রাষ্ট্র ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পর্যবসিত হয়। এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তখন রাষ্ট্রটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং ভেঙে যেতে পারে। জনগণ নিজেরা জেলখানায় বন্দি হওয়ার জন্য কোনো রাষ্ট্র তৈরি করে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ওয়েস্টফেলিয়া পরবর্তী আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর অনেকগুলোতেই জনগণ নিজেরা নিজেদের রাষ্ট্রে বন্দি। রাজনীতিবিদরা সতর্ক না হলে এ ধরনের ভঙ্গুর বা ব্যর্থ রাষ্ট্র টিকে থাকে না। পৃথিবীতে এই ভেঙে যাওয়া বহু রাষ্ট্রের নজির আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। আমি মনে করি যেসব রাজনীতিক জনগণ, রাষ্ট্র ও সমাজের এই গুঢ় সম্পর্ককে উপলব্ধি করেন, এবং সেটিকে দুর্বল করার বদলে সংহত করার ব্রতী হোন, তারা স্বপ্রণোদিত হয়েই মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করবেন। রাজনীতিকদের মধ্যে এই চেতনা যত বাড়বে, তত বেশি একটা মানবাধিকার-বান্ধব রাষ্ট্রীয় কাঠামো, বা নতুন বন্দোবস্ত তৈরি করা সম্ভব। বিশ্বের যেখানেই জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে গেছে, সর্বত্রই এটি প্রযোজ্য।

বাংলা আউটলুক: সময়  দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া : আপনাকেও ধন্যবাদ।