আমরা রাজনীতির চামচিকা নই, আমরা রাজনীতির কিং

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না

মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি। বিএনপির নেতৃত্বে চলমান যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম নেতা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সদা সোচ্চার। নানা ভয় ও প্রলোভন উপেক্ষা করে তিনি আন্দোলনে অটুট আছেন। ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না কথা বলেছেন বাংলা আউটলুকের সঙ্গে।

 
বাংলা আউটলুক : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এদের মধ্যে কোনো কোনোটি সংসদে বিরোধী দল হতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবদার করছে। এ অবস্থায় নির্বাচন কেমন হবে বলে মনে করেন?

মাহমুদুর রহমান মান্না : রাতের ভোটের অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটা অবৈধ ও একতরফা নির্বাচন করতে চাইছে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে তারা নষ্ট করে দিয়েছে। এখন জনগণের ভোট লাগে না। গণভবন থেকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশন তাদেরকে বিজয়ী ঘোষণা করে। এ জন্য জাতীয় পার্টি, সরকারের তৈরি বিভিন্ন কিংস পার্টি গণভবনে ধর্ণা দিচ্ছে যাতে প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ পায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবদার করছে আসনের জন্য। কারণ দেশে এখন যে বাস্তবতা তাতে প্রধানমন্ত্রী এখন সব কিছু একাই চালান। তাকে ম্যানেজ করতে পারলে সব মুশকিলের আসান। প্রধানমন্ত্রীর দয়া হলে তাকে কষ্ট করে ভোট করতে হবে না। জনগণের কাছে যেতে হবে না। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সরকার একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে এসব চেষ্টা করছে। তারা প্রহসনমূলক একটি নির্বাচন করে দেখাতে চায়, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সরকার যা চায়, তা হবে না। জনগণ তা হতে দেবে না। জনগণের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে এমন নজির বিশ্বের কোথাও নেই, ইতিহাসে নেই।

বাংলা আউটলুক : আন্দোলনকারী দলগুলো এক মঞ্চে আসুক এমন বক্তব্য দিচ্ছেন কেউ কেউ। এ অবস্থায় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দলের এক মঞ্চে আসার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি? আগমী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম সম্পর্কে কিছু বলুন।

মাহমুদুর রহমান মান্না : সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আমরা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেছি। এরপর ২৮ অক্টোবর বিএনপির কর্মসূচি পণ্ড হওয়া এবং বিএনপিসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর নেতাদের গ্রেফতার করার কারণে অনেকে আত্মগোপনে গেছেন। এ অবস্থায় হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তবে আমরা যেহেতু একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে চাই তাই জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির কথা ভাবছি। ইতিমধ্যে পেশাজীবী পরিষদ, গুম হওয়া নেতাদের স্বজনদের নিয়ে, কারাবন্দী নেতাদের স্বজনদের ব্যানারে কর্মসূচি পালন করেছি। বিশেষ করে ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের মানববন্ধনের কর্মসূচি সমাবেশে রূপ নিয়েছিলো। এভাবে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি আসবে সামনে। জামায়াতসহ যারা নির্বাচন বর্জন করছে তারা যুগপৎভাবে কর্মসূচি পালন করছে। এভাবেই চলতে থাকবে। একমঞ্চে আসার মতো সিদ্ধান্ত নেই।

বাংলা আউটলুক : ব্যবসায়ীরা প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কথা বলেছেন। এখন হঠাৎ নিরপেক্ষ হয়ে গেছেন। বলছেন রাজনীতি যার যার, ব্যবসা সবার। এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?

মাহমুদুর রহমান মান্না : শুধু ব্যবসায়ী কেন? সময় আসছে। সরকারকে একা ফেলে সবাই জনগণের সঙ্গে আসবেন। জনতার কাতারে দাঁড়াবেন। আমি মনে করছি, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তারা হঠাৎ নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পশ্চিমা বাজারে গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানি আমাদের প্রধান ব্যবসা। এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে। হঠাৎ করে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে পথে বসবেন ব্যবসায়ীরা। এর আগে ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেছেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তারা চাপের কাছে নতি স্বীকার করে এমনটা করেছিলেন। দ্বিতীয়বার যে কথা বলেছেন, তা বাস্তবতা থেকে। কারণ ব্যবসায়ীরাও তো দেশের মানুষ। তারা তো জানে দেশের মানুষ কী চায়। তারা জনগণের বিরুদ্ধে যাবে কী করে। আমি মনে করি, ব্যবসায়ীরা গণমানুষের পক্ষে থাকবে।

বাংলা আউটলুক : মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বে কল্যাণ পার্টি ও অপর দুইটি দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। আপনি কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ায় আপনার বিরুদ্ধে গুঞ্জন তৈরি হয় আপনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

মাহমুদুর রহমান মান্না : সরকার চেষ্টা করেছিল বিভিন্ন দল ভাঙতে, নতুন নতুন দল করতে। খেয়াল করে দেখেন, পাকিস্তান আমলেও কিন্তু রাজাকার পাওয়া গেছে, এবার তো রাজকারও পাওয়া যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এবার রাজাকার-আলবদরও পায়নি। নতুন মনোনয়ন দেবে তা-ও পায় না। বড় ধরনের অর্থের প্রলোভন দেখিয়েও উল্লেখ করার মতো কাউকে নিতে পারেনি।
সরকার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে বিরোধী দলগুলো থেকে নেতা ভাগিয়ে নিতে চেয়েছিল ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে। গরুর হাটে মানুষ যেভাবে গরু কেনে সেভাবে সরকার নেতাদের কিনতে চেয়েছে। কিন্তু তাতে সাড়া পায়নি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর নির্বাচনে গিয়েছেন। তিনি তেমন জনসমর্থিত নেতা নন। কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান এখন পর্যন্ত নিজেকে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে পারেননি। ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা থেকে তিনি হয়তো গিয়ে থাকতে পারেন।

 বাংলা আউটলুক : রাজপথের কর্মসূচিতে না থাকার কারণে আপনার সম্পর্কে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল যে আপনি নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। আসলে বিষয়টি কী ছিল?

মাহমুদুর রহমান মান্না : নেতাদের গ্রেফতারে যেভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছিল তাতে রাজপথের কর্মসূচিতে কয়েকদিন অংশ নিতে পারিনি। কারণ শুধু শুধু গ্রেফতার হয়ে কোনো লাভ নেই। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে থাকতে হবে। তাছাড়া আমার শরীর ভালো ছিলো না। তাই গ্রেফতার এড়াতে কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলাম। যখন সুবিধাজনক মনে করেছি, রাজপথে চলে এসেছি। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে অংশ নিয়েছিলাম। আমি দালাল না। আমরা রাজনীতির চামচিকা নই, আমরা রাজনীতির কিং। আমাকে কেনার ক্ষমতা সরকারের নেই।

বাংলা আউটলুক : দেশের জনগণের প্রতি কোনো আহবান আছে কি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে?

মাহমুদুর রহমান মান্না : ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকার জনগণের চিন্তা করেনি। এখনও জনগণের চিন্তা করছে না। ভোটের জন্য জনগণের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনগণে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অন্যদিকে আমরা জনগণের মুখে হাসি ফোটাতে আন্দোলন করছি। গুম, খুন, হামলা, মামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন শিকার করে রাজপথে আছি। জনগণ আমাদের ফেরাবে না। জনগণের প্রতি একটাই অনুরোধ, ধৈর্য ধরুণ। হতাশ হবেন না। আগামীর আন্দোলনে আপনারা অংশগ্রহণ করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।