নির্বাচন হয়ে গেলেই বাড়বে জ্বালানি তেলের দাম

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকার মতো চরমপর্যায়ে না গেলেও গত বছর থেকে সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সংকটে আছে বাংলাদেশ। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি চরম রিজার্ভ সংকটও দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৯ কোটি ডলার ঋণ দেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের অন্যতম শর্ত অনুসারে সরকার ঘোষিত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে স্থানীয় বাজারে। এতে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশংকা করছেন।

আই্এমএফ-এর ঋণের শর্তাবলী মেনে চলার জন্য বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মার্চ থেকে কার্যকর আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সংযুক্ত একটি স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে। এই সিস্টেমের জন্য খসড়া সূত্রটি ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে যা পরবর্তী আইএমএফ-এর বোর্ড সভার সাথে মিলে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের পর বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রক্রিয়াাটি কার্যকর করবে।

জ্বালানি তেল ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী সরকারি সংস্থা বিপিসি-এর একজন সিনিয়ার কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে, স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন।

সূত্র জানায়  প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকারের অধীনে এটি বাস্তবায়ান করা হবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে ওঠানামা করেছে। দাম সম্প্রতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর পর্যন্ত স্থিরভাবে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পরবর্তী অস্থিরতা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশের জ্বালানির দাম সর্বশেষ ৩০ আগস্ট ২০২২-এ সামঞ্জস্য করা হয়েছিল।

গত বছরের ৩০ আগস্ট এক নির্বাহী আদেশে সরকার প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৯ টাকা, পেট্রোল প্রতি লিটার ১২৫ টাকা এবং অকটেন প্রতি লিটার ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করলেও কোনো পরিবর্তন করেনি সরকার। যদিও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিআরসি) দেরিতে সৌদি আরামকোর ঘোষিত ভোক্তা মূল্য অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য নির্ধারণ করে আসছে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড় করেছে আইএমএফ। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময়  রাত ৯টায় সংস্থাটির পর্ষদে বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের প্রস্তাব উত্থাপিত হতে যাচ্ছে।

অর্থ বিভাগের সূত্র জানিয়েছে, কয়েকদিন আগে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বাংলা আউটলুককে যা নিশ্চিত করেন।

এর আগে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাবের অনুমোদন দেয় আইএমএফের পর্ষদ। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। গত ফেব্রায়ারিতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বুঝে পায় বাংলাদেশ। গোটা প্যাকেজে দুই ধরনের ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে বর্ধিত ঋণ সহায়তা বা বর্ধিত তহবিল (ইসিএফ অ্যান্ড ইএফএফ) থেকে পাওয়া যাবে ৩৩০ কোটি ডলার। রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাওয়া যাবে ১৪০ কোটি ডলার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।

ঋণ পাওয়ার জন্য আইএমএফ বাংলাদেশকে কোয়ান্টিটেটিভ পারফরম্যান্স ক্রাইটেরিয়া (কিউপিসি) বা পরিমাণগত কর্মসক্ষমতার মানদণ্ড, ইন্ডিকেটিভ টার্গেটস (আইটি) বা নির্দেশক লক্ষ্য এবং স্ট্রাকচারাল বেঞ্চমার্ক (এসবি) বা কাঠামোগত মাপকাঠি পূরণের শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর), প্রাইমারি ব্যালান্স ও এক্সটার্নাল পেমেন্টস এরিয়ার্স সংক্রান্ত শর্তগুলো কিউপিসির আওতাভুক্ত।

জানা গেছে, নিট রিজার্ভ-সংক্রান্ত শর্ত এখনো পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। নির্দেশক হিসেবে কর রাজস্ব, সামাজিক খাতে সরকারের ব্যয় এবং সরকারের মূলধনি বিনিয়োগ সংক্রান্ত কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল আইএমএফ। লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে রাজস্ব আহরণ করতে পারেনি এনবিআর।

আইএমএফের শর্তে গত জুনের মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ, বিপিএম৬ অনুসারে রিজার্ভের হিসাবায়ন, বাজারভিত্তিক বৈদেশিক মুদ্রার দর নির্ধারণ, ব্যাংকের পাইলট রিস্কভিত্তিক নজরদারির কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের তথ্য প্রকাশের কথা বলা হয়েছিল।

এ ছাড়া জুলাইয়ের মধ্যে সুদহারে করিডোর পদ্ধতি গ্রহণেরও শর্ত দিয়েছিল সংস্থাটি। শর্ত ছিল সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন ও ফাইন্যান্স কোম্পানি আইনের খসড়া জমা দেয়ারও। সেপ্টেম্বর শেষে জলবায়ু ও সবুজ উদ্যোগকে সংহত করতে টেকসই সরকারি কেনাকাটার নীতি গ্রহণ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের শর্ত ছিল। ঋণ কর্মসূচিতে চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ে সময়ভিত্তিক মূল্য পদ্ধতি নির্ধারণেরও শর্ত দেয়া হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একতরফা নির্বাচনের বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যমান ঝুঁকি এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতে ক্রমাগত সুদহার বৃদ্ধির সম্মিলিত প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এর ফলে চাপে পড়েছে  স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। এ অবস্থায় স্বল্পমেয়াদি নীতি অগ্রাধিকারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ (বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর), নাজুক জনগোষ্ঠীর ওপর এসব অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের প্রভাবকে সহনীয় করা এবং বহিস্থ প্রভাবকের অভিঘাত মোকাবেলায় সহনশীলতা তৈরিতে জোর দিতে হবে।

তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ৪ অক্টোবর গৃহীত নীতি সুদহার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে কঠোর আর্থিক ও মুদ্রানীতি গ্রহণ এবং বিনিময় হারকে আরো বেশি নমনীয় করা হলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের ঋণ অনুমোদন করা হয় গত জানুয়ারিতে। সে সময় বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট বেসিসে ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা গত নভেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

জানুয়ারিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার, যা গত নভেম্বর শেষে কমে ২৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুসারে বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন আরো কম।

গত ৬ ডিসেম্বর বিপিএম৬ অনুসারে বাংলাদেশের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশের নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ বা (এনআইআর) সংরক্ষণেরও শর্ত রয়েছে। এ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের মতো হওয়ার কথা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে না।

শর্ত অনুযায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণের সুদহার কিছুটা বাড়ানো হলেও তা এখনো মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তাদের ভাষ্যমতে, মুদ্রার বিনিময় হার এখনো পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হয়নি। ফলে খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের ব্যবধান থেকে যাচ্ছে। এতে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স আহরণ নিরুৎসাহিত হচ্ছে।