নতুন করে ২ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে

ছবি: বিশ্ব ব্যাংক

শেষ দেড় বছরে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বাংলাদেশে। মুদ্রাস্ফীতির অস্বাভাবিক উল্লম্ফনকে দেশের অর্থনীতিবিদরা নাম দিয়েছেন ‘গ্রেডফ্লেশন’ বা মুনাফাখুরির শেষ পর্যায় তথা ‘লোভ-উদ্ভূত মুদ্রাস্ফীতি’। এই লোভ-উদ্ভূত মুদ্রাস্ফীতির কারণে নিত্যপণ্যের দাম প্রায় ৪০ থেকে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত  বৃদ্ধি পেয়েছে গত দেড় বছরে। যেখানে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম স্থির ছিল ক্রমান্বয়ে।

দেশের বিদ্যমান সকল ভোক্তা, খাদ্য প্রতিযোগিতা আইন ভঙ্গ করার পরও আওয়ামী লীগের মদদপুষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠান বহাল তবিয়তে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এস আলম, সিটি, প্রাণ, বসুন্ধরা, টিকে, আকিজ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, প্যারাগন, কাজী পোলট্রি, সিপি, এসিআই, স্কয়ারসহ আরো কিছু কোম্পানি ও গুটিকয়েক ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ডে এক নীরব দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিনাতিপাত করছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। তাদের এহেন ডাকাতি কর্মকাণ্ডে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে প্রায় ২ কোটি মানুষ। আলু, মুরগি, ডিম এবং পেঁয়াজের মতো জিনিস ছাড়াও চাল, ডাল, আটা, ময়দা, সুজি, মসলা, চিনি, লবণ, মাছ, মাংস এমনকি সবজির দামও মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চোলে গেছে। মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪০ থেকে ১৩৭ শতাংশ।

ইউরো জোনে মূল্যস্ফীতি দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৪.৩%। বাংলাদেশের কাছাকাছি শ্রীলঙ্কা উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে ধীরে ধীরে নিচে চলে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনোভাবে লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন, এ বৃদ্ধির সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা তার নেই। এই কেন নেই থেকেই বোঝা যায় সেই আওয়ামী-ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সুবিধাভোগী কে এবং কারা।

ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, এক-দেড় বছর আগে ৫৫৩ টাকায় মোটামুটি পরিমাণ চাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, লবণ ও ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারতেন ঢাকায় বসবাসকারী বেসরকারি চাকরিজীবী আমিনুর রহমান। পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী আমিনুর একই পরিমাণ পণ্য এখন কিনছেন ৬৪৩ টাকায়, যা আগের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, ২০২২ সালের মে মাসের সঙ্গে যদি চলতি বছরের একই মাসের তুলনা করলে আরও অনেক খাতেই আমিনুরকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

ঢাকার মিরপুরে ২ রুমের যে বাসাটিতে ভাড়া থাকেন আমিনুর, তার ভাড়াও বৃদ্ধি করেছেন বাড়িওয়ালা। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন খরচও। আমিনুর জানান, যদিও বছর শেষে তার বেতন বেড়েছে ৩ হাজার টাকা, কিন্তু গত এক বছরে তার সামগ্রিক মাসিক ব্যয় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেড়েছে। যা তার বেতন বৃদ্ধির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। অতিরিক্ত এই ব্যয় বহন করতে তার পারিবারিক বিভিন্ন কেনাকাটায় কমিয়ে দিতে হচ্ছে। চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে আমিনুরের মতো আরও অনেকের নাভিশ্বাস অবস্থা।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গণনায় ৩৮৩টি খাদ্য ও খাদ্যপণ্যকে বিবেচনায় রাখে। এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে গড়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ বা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক আট শতাংশ বেশি বেড়েছে।খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে। সামষ্টিক এই মূল্যস্ফীতি থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্ফীতি কয়েক গুন বেশি বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্লেষকরা মনে করেন, উৎপাদক বা সরবরাহকারী বা ব্যবসায়ীদের একটি অংশের দ্বারা ‘লোভ মুদ্রাস্ফীতি’ বা বাম্পার মুনাফা কোনো অর্থনীতিতে ন্যায়সংগত হতে পারে না। কারণ এটি মানুষের প্রকৃত আয়, বিশেষ করে সীমিত আয়ের গোষ্ঠীর লোকেদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে। অসাধ্য মূল্যের জন্য যন্ত্রণার মধ্যে থাকা সমাজের নিম্নশ্রেণির মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুর এবং অন্যান্য সীমিত আয়ের উপার্জনকারীরা।

সরকার এই অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা পরে সংশোধন করে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করে। কিন্তু বর্তমান হার তার চেয়েও বেশি। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সংকট আরও গভীর হয়েছে।

রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় বসবাসকারী একটি বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবী মোস্তফা কামাল বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য কেনা ৩০ শতাংশ কমাতে হয়েছে। এমনকি আমি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়াও করা বন্ধ করে দিয়েছি। এ নিয়ে পরিবারে অসন্তোষও আছে।’ খিলগাঁওয়ে বসবাসকারী একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মচারী আলতাফ হোসেন বলেন, ‘বাজারে পণ্যের দামের পরিস্থিতিতে আমি বেশ চিন্তিত। কীভাবে মাসিক খরচ জোগাব, এই চিন্তায় রাতে ঘুমাতেও পারি না’। একটি মোবাইল ফোন বিক্রি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী সোহান হোসেন জানান, তার মা ৪ বছরের বেশি সময় ধরে অস্টিওআর্থারাইটিসে ভুগছেন। তিনি বলেন, মায়ের চিকিৎসার খরচ কীভাবে চালাব, সারাক্ষণ তা নিয়ে চিন্তায় থাকি। যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে চিকিৎসার খরচ কীভাবে বহন করব?

এর মধ্যে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবরে বাংলাদেশের বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ে কেজিতে ২০ টাকা। অথচ দেশে বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের ঘরে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। তুলকালাম কাণ্ড ঘটে কাঁচামরিচের বাজারেও। সরবরাহে ঘাটতির অজুহাতে প্রতি কেজি কাঁচামরিচের দাম ১০০ টাকা থেকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে হাজার টাকায় পৌঁছে।

এদিকে গত এপ্রিল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দর নিম্নমুখী। কিন্তু দেশের বাজারে পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী। সরকার বারবার দাম বেঁধে দিলেও তা কার্যকর হয়নি। একইভাবে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধের দাম কমলেও দেশের বাজারে কমেনি।

কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি? বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডলার সংকট, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন কম ইত্যাদি অজুহাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মুষ্টিমেয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। নানা কায়দায় সিন্ডিকেট গড়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় তারা। ভোক্তারা বাড়তি দামের চাপে পড়লেও সরকারের মন্ত্রী-সচিবরা বলছেন, ‘সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়’ তারা।

অর্থনীতিবিদ ও ভোক্তা অধিকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সিন্ডিকেট প্রতিরোধ করতে হবে। কারা সিন্ডিকেটে জড়িত তা সরকারের নীতিনির্ধারকরাও জানেন। তবে সিন্ডিকেটে জড়িতদের হাত এতই লম্বা যে, তা ভাঙা দুরূহ। রাজনীতির ঊর্ধ্বে এসে ব্যবস্থা না নিলে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। তবে রাষ্ট্র চাইলে যে কোনো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

গত ২৬ জুন সংসদে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বড় গ্রুপগুলোকে জেল-জরিমানা করা যায়; কিন্তু তাতে হঠাৎ যে সংকট তৈরি হবে, তা সইতে কষ্ট হবে। তাই আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়।’ এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘শুধু জেল-জরিমানা ও পুলিশ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সমাধান নয়।’ অনেকেই মনে করেন, মন্ত্রী-সচিবদের এসব বক্তব্যের সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সিন্ডিকেট থাকলে তা ভাঙা যাবে না– এটা হতে পারে না। সিন্ডিকেট কত শক্তিশালী, তা দেখব।’ এ ব্যাপারে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ‘ধরবেন’ বলে জানান। তবে পরে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, ওই সংবাদ সম্মেলনের পর প্রায় দুই ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন; কিন্তু এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে কিছু বলেননি, তিনিও তাঁকে কিছু বলেননি।

সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে। তবে কারা ওই সিন্ডিকেটে জড়িত, তা থেকে যায় আড়ালে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে চিনির বাজার মূলত সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম গ্রুপের হাতে। ভোজ্যতেলের বাজারে আধিপত্য এস আলম, সিটি, মেঘনা, টি কে, বসুন্ধরা, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলসহ কয়েকটি কোম্পানির। এসব কোম্পানির মালিকরা সবাই কমবেশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নানা সময়ে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে বাজারে কারসাজির অভিযোগ উঠলেও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

কারসাজির অভিযোগ ওঠার পর চাল, তেল, ডিম, মুরগি, লবণ, কাগজ, টয়লেট্রিজ, রড, সিমেন্টসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম নিয়ে সমীক্ষা শুরু করে ‘বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন’। এর মধ্যে গত বছর এসব পণ্যের ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ৪৫টি মামলাও করে তারা। এর মধ্যে চাল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ২১টি, ডিম-মুরগি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ছয়টি ও ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আটটি মামলা বেশ আলোচনায় আসে। তবে এখন পর্যন্ত ওই সব মামলার কোনো সুরাহা হয়নি।

টিসিবির হিসাবে এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। একইভাবে কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমলেও দেশের ব্যবসায়ীরা সেই হারে দাম কমাননি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ৫০ বছরে দেশে চালের উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে। তবুও স্থির নয় চালের বাজার। ভরা মৌসুমেও চালের দামে নাকাল হচ্ছে ভোক্তা। নতুন করে ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশে চালের দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের ধারণা, এ ক্ষেত্রেও বাজার কারসাজি বা সিন্ডিকেট হতে পারে।

চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্যটির ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও মৌসুমি ব্যবসায়ী। তারা ধান কিনে চাল মজুত করে এবং চাহিদা বাড়লে বাড়তি দামে তা বিক্রি করে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে।

চলতি বছর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি.) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করপোরেট প্রতিষ্ঠান চালের বাজারে ঢুকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ধান-চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে পাঁচবার তা হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ ও মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেন চালকল মালিকরা। তারা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেন।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গত বছর এক অনুষ্ঠানে চালের দাম বাড়ার পেছনে ছয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান– এসিআই, আকিজ, বসুন্ধরা, প্রাণ, সিটি ও স্কয়ার গ্রুপকে দায়ী করেন।

কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের তদারকি প্রতিষ্ঠান চালের বাজার কারসাজিতে জড়িতদের পরিচয় জেনেও নিশ্চুপ থাকছে। ফলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীরা জানান, খামারি থেকে খুচরা পর্যায়ে আসা পর্যন্ত চার হাত ঘোরে ডিম। উৎপাদক, ডিলার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের খরচ ও মুনাফা যুক্ত করে ভোক্তা পর্যায়ে ডিম বিক্রি করেন। ঢাকার কাপ্তানবাজার, কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে ডিমের দাম জানিয়ে দেন। ওই দামে ডিম বিক্রি করতে চাইলে স্থানীয় মধ্যস্থতাকারী খামারে গাড়ি নিয়ে আসেন। তবে ডিমের বাজারে সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন।

গরুর মাংসের বাজারও এখন বেশ চড়া। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। খামারিদের অভিযোগ, মহিষের মাংস আমদানি বন্ধের পর থেকে একটি গ্রুপ গরুর মাংসের বাজার অস্থিতিশীল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই চক্রের মধ্যে আছে আমদানিকারক, মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপণ্যের ব্যবসা মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে। এরা অলিগোপলি বাজার সৃষ্টি করে রাখে। একজন দাম বাড়ালে অন্যরা তা অনুসরণ করে। তারা ঝোপ বুঝে কোপ মারে। এভাবে ভোক্তার পকেট কাটা হচ্ছে বছরের পর বছর। বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় এমন কারসাজি।

গোলাম রহমান বলেন, দাম যে শুধু বড়রা বাড়ায়, তা নয়। সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীর মধ্যে অতি মুনাফার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। খুচরা থেকে উৎপাদনকারী– সবাই এখন সুযোগসন্ধানী। এ ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণে দুর্বলতা লক্ষণীয়।

রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সিন্ডিকেট চক্রকে কোনোভাবে রোখা যায় না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। সমকালকে তিনি বলেন, ‘যারা বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট করছেন, তারা রাজনীতিতেও সক্রিয়। কারা সিন্ডিকেশনের সঙ্গে জড়িত, তা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরাও জানেন। তাই রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা হয় না।’

অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘সরষের ভেতরে ভূত আছে। সেই ভূত না তাড়ালে সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ জেল-জরিমানা ছাড়াও সামাজিকভাবে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’ তার মতে, প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা না গেলে বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা কমিশন নখদন্তহীন। এ কারণে সিন্ডিকেট তাদের তোয়াক্কা করে না।

মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন খাতে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। 'এটি ভবিষ্যতে তাদের জীবনে নেতিবাচক জটিলতা সৃষ্টি করবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান আরও বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির ফলে স্থায়ী আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যম ও স্থির আয়ের মানুষের দুর্দশা আরও বেড়েছে। নতুন করে ২০-২৫ মিলিয়ন (দুই  থেকে আড়াই কোটি) মানুষ আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, যদি এই অবস্থার কোনো পৰৱৰ্তন না হয়

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে বলেছে, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা। গত এক বছরে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সামান্য কমেছে। তবে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকাই দীর্ঘ। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশের ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে নতুন  করে বেড়েছে সবকিছুর দাম ।

প্রতিযোগিতা কমিশনে অনেক চলমান মামলার প্রসঙ্গে ক্যাবের সভাপতি বলেন, ‘আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়; হয়ে ওঠে আরও বেপরোয়া। এতে উৎসাহিত হয় অন্যরা। তবে রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নয়। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়ে সম্মত, ভোক্তারা তাতে আশাবাদী।’

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির আক্রমণ আর থামছে না। একটার একটু কমে তো আরেকটা বাড়ে। সরকারের ভূমিকায়, কথাবার্তায় মনে হয় দাম বৃদ্ধিতে মানুষের ভোগান্তি বোঝার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই তাদের নেই। উল্টো ডিমের দাম বৃদ্ধি সামাল দেওয়ার জন্য ‘আর কোনো উপায় না দেখে’ আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। দেশে স্যালাইনের চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি করার সক্ষমতা আছে। কিন্তু তারপরও পাওয়া যাচ্ছে না, অনেক দামে কিনতে হচ্ছে। এর কারণ সন্ধানের কোনো চেষ্টা না করে সরকারের লোকজন এর আমদানির সম্ভাবনার কথা বলছে। আলুর দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পর আলু নিয়েও একই তৎপরতা শুরু হয়েছে। এর বাইরে বাড়তে থাকা বাসভাড়া, বাসাভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বর্ধিত বিল এগুলোও চলছে। সরকারের কর ফি যে বাড়ছে, তাও টের পাচ্ছে মানুষ নানাভাবে।  

তিনি বলেন, এমন অনেক পণ্যের বাজারদর চড়া থাকছে যেগুলো দেশে উৎপাদিত এবং উৎপাদনের স্তরে সেই পণ্যের দাম ভোক্তা পর্যায়ে দামের তুলনায় অনেক কম। যখন ঢাকার বাজারে মাছ ফল সবজি চাল ইত্যাদির দাম বাড়ছে তখন চাঁদপুর বা দিনাজপুরসহ দূরবর্তী অঞ্চলের উৎপাদকের প্রাপ্তি দাম বাড়ছে না। মানে কৃষক যখন বিক্রি করছে ৫ টাকায়, তখন আমাদের কিনতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকায়! তাহলে বর্ধিত দাম যাচ্ছে কোথায়? এই অনুসন্ধানেই আমরা পাই তথাকথিত মুক্তবাজারের আড়ালে কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ও একচেটিয়া কর্তৃত্বের সন্ধান। কতিপয় আমদানিকারক, কতিপয় পাইকার, পণ্য বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় খাজনা বা চাঁদাবাজ গোষ্ঠী কৃত্রিম দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফার আয়তন বৃদ্ধি করে। উৎপাদনের পর্যায় থেকে ভোক্তার পর্যায় পর্যন্ত পণ্যের যে যাত্রা সেখানেই অযৌক্তিক দাম বৃদ্ধির বড় কারণ ঘটে।

আনু মুহাম্মদ বলেন, উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিন্তু প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সরকারি দলের নানা বাহিনী, পুলিশ প্রভৃতির সংখ্যা ও চাঁদাবাজি সক্রিয়তা আগের থেকে অনেক বেশি। ঘাটে ঘাটে তাদের চাহিদা পূরণের পুরো চাপ নিরীহ অসংগঠিত ক্রেতাদের ওপরই পড়ে। এর সঙ্গে যোগ হয় প্রভাবশালী আমদানিকারক ও পাইকারি জোগানদারদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের সফল কারসাজি।