হরতাল-অবরোধ ঠেকাতে সরকারের বাড়তি খরচ

আবারো একতরফা নির্বাচনের দিকে আগাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে। সামনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই এবং প্রচার-প্রচারণার পর ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচের তারিখ নির্ধারিত আছে। যদিও দেশের বাতাসে নেই ভোটের আমেজ। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি সরকারকে রেখেছে অস্বস্তিতে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধ থেকে কীভাবে রেহাই পাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে সরকারের বিভিন্ন মহল। কারণ হরতাল-অবরোধ ঠেকাতে ১০ হাজার আনসার -ভিডিপি সদস্যকে রাস্তায় নামিয়েছে সরকার। যাদের জন্য প্রতিদিন খরচ হচ্ছে বাড়তি ৬৪ লাখ টাকা। গত ২৯ অক্টোবর থেকে কয়েক দফায় বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধের কারণে সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। খোদ অর্থ বিভাগই নিজেদের ঘোষিত কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতি মানতে পারছে না।

জুলাই মাসে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণার পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা বিবেচনায় কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতি নেয় সরকার। যার আওতায় সব ধরনের গাড়ি কেনা, বিদেশ ভ্রমণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ব্যয় কমানো নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় থাকলেও অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে সরকারের সব বাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আগামী ৭ জানুয়ারি ১৬ হাজার কোটি টাকার নির্বাচন হয়ে গেলেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অবরোধ-হরতাল থেমে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরার্মশে এ ধরনের অস্বাভাবিক এবং উদ্ভূত রাজনৈতিক অবস্থায় সরকারের ব্যয়ের কোনো ধারণা করা হয়নি।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগ দুই সপ্তাহে ৮০টি মোটরসাইকেল কেনে। আর এ জন্য কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতি উপেক্ষা করে এক কোটি ২০ লাখ  টাকা ছাড় করা হয়।

আরো জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটের অংশ হিসাবে, মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা এবং নজরদারি জোরদার করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) জন্য ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগের বাজেটে ১৫ কোটি টাকা এনএসআই কর্মকর্তা ও কর্মচারী ভ্রমণ ব্যয় হিসেবে ধরা হয়েছিল।

অন্য একটি সার্কুলারে বলা হয়েছে, ‘আপারেশন অব সেফ ট্রান্সপোর্টেশন’র আওতায় মাত্র দুই দিনে (১৫ ও ১৬ নভেম্বর) সরকার খরচ করেছে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এই ব্যয়ের লক্ষ্য ছিল সারাদেশে ১০ হাজার আনসার কর্মী মোতায়েন করা। যাদের কাজ হলো রেল স্টেশন, বাস স্টপ এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা রক্ষা করা এবং বিরোধীদের দেশব্যাপী বিক্ষোভের সময় পুলিশকে সহায়তা করা।

এদিকে চলতি অর্থ বছরে পুলিশ অধিদপ্তর নির্বাচনের আগেই ১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার মোটরসাইকেল, জিপ কার এবং ডবল কেবিন পিকআপ ভ্যান কিনতে চাইলেও অর্থ বিভাগ শুধু ২৮টি ডবল ক্যাবিন পিকআপ ভ্যান কেনার অর্থ ছাড় করতে চাইছে।

সরকারি গাড়ি তৈরির কারখানা প্রগতি থেকে প্রতিটি গাড়ি কিনতে  খরচ পড়বে ৫৫ হাজার টাকা। যার মোট খরচ ১৫ কোটি টাকা। তবে পুলিশ গুরুত্ব দিচ্ছে ১২৫ সিসির ৫০টি মোটরসাইকেল কেনায়। এতে ব্যয় হবে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। অর্থ বিভাগ পুলিশকে প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাবে এ অর্থ দিতে চায় না। এ বিষয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘হিট অ্যান্ড রান হামলা প্রতিরোধ করতে আমাদের বাইক এবং পিকআপ ভ্যানের খুব প্রয়োজন।’

জানা গেছে, হরতাল-অবরোধের সময় ৮-৯ হাজার পুলিশ কর্মকর্তা দিনের বেলা কাজ করছেন। রাজধানীতে রাতে যা ৭ হাজারে নেমে আসে। যদিও ডিএমপির রিপোর্ট অনুসারে, এ সংখ্যাগুলো পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। পুলিশ সদস্যরা হরতাল-অবরোধের সময় ১৪০ টাকা বিশেষ খাদ্য ভাতা পান, তবে প্রায়শই এ টাকা পেতে এক সপ্তাহ সময় লাগে।

হরতাল-অবরোধে ঢাকায় প্রতিদিন ৮ হাজার পুলিশ মোতায়েন বাবদ ১০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। উপরন্তু শহরের পুলিশ কর্মকর্তারা প্রতি মাসে নিয়মিত ঝুঁকি ভাতা পাচ্ছেন।

এ ছাড়া অবরোধ-হরতালে পরিবহন বা স্থাপনা ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদানকারীকে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের একটি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, ২৯ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোর দেশব্যাপী অবরোধ ও হরতাল (হরতাল) চলাকালে মোট ৩৭৬টি অগ্নিসংযোগ এবং ৩১০ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

উল্লেখ্য, ৩০ নভেম্বর পর্ষন্ত বিরোধী দলের প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী সারা দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী হয়েছেন। এদিকে কারাগারে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বাড়ি এবং বিএনপি নেতা ও সিলেট সিটি করর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হকের বাড়িসহ ৯৩ বিএনপি নেতাকর্মীর বাসায় হামলা হয়েছে। যার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত দেশব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ২০০০ বিএনপি গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে, এই তারিখের পরে এই সংখ্যা কমে ১৮১৬-তে দাঁড়ায়।