মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসলে পেছাবে জাতীয় নির্বাচন

বিএনপির ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর থেকেই দেশে সংঘাতময় রাজনীতি নতুন করে শুরু হয়েছে। বিএনপির ওই মহাসমাবেশ শেষ পর্যন্ত ভন্ডুল করে দেয় পুলিশ। এরপর থেকে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো। বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। কর্মসূচির বাইরেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার দিকে তাকিয়ে আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মানবাধিকার দিবসকে সামনে রেখে ঘোষণা করা নিষেধাজ্ঞার আওতায় বাংলাদেশকে রাখেনি।

জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা না আসলেও এ নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনেও চলছে জোর আলোচনা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন কৌশল নিয়ে ভাবছে সরকার। গত সপ্তাহে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের এক অনির্ধারিত বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা করা হয়। কোনো ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসলে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করা হতে পারে বলে ওই বৈঠকে সচিবদের কেউ কেউ মন্তব্য করেন। তখন ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে সরকার সচিবদের সঙ্গে পরামর্শে বসতে পারে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন বাংলা আউটলুককে বলেন, সরকার আমাদের কাছে জানতে চাইবে কীভাবে নতুন মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবিলা করা যায়। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আবারো প্রধানমন্ত্রী একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। সে হিসেবে জাতীয় নির্বাচনের নতুন একটি তারিখ নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হবে। তখন নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি কঠোর অবস্থা বজায় রাখে, তবে নতুন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সব ধরনের রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেবে সরকার।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুরক্ষা সেবা বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, অনির্ধারিত ওই বৈঠকে আরো বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এখনো না দিলেও তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যেতে শুরু করেছে। এভাবে রপ্তানি আয় কমে যেতে থাকলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞারও প্রয়োজন পড়বে না। এ ক্ষেত্রে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণ হতে পারে দেশে শ্রম পরিস্থিতির মান এবং গত কয়েক মাসে তৈরি পোশাক কারখানার এক নারী  কর্মীসহ চার শ্রমিক যুবলীগ ও পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন।

বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি আয় কমেছে ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন মোট আয় হয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত বছর একই সময় আয় হয়েছিল ৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তারা দেশের রপ্তানিকারকদের জানিয়েছেন, আমেরিকান ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর) বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করতে পারে। ফলে সুতার ওপর আমেরিকার মোট আমদানি শুল্ক হবে ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে সুতাবিহীন কাপড়ের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক হবে ৩৭ শতাংশ । ইতিমধ্যে গত ৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নগরীর খুলশীতে স্টক হোল্ডারদের এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইস্যু আসছে। আপনারা দেখেছেন যে প্রেসিডেন্ট মেমোরেন্ডাম সাইন করেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওরাও ভিজিট করে গেছে। সেটাও দেশের রপ্তানিকারকদের জন্য এক ধরনের প্রেশার। মার্কিন ক্রেতারা এরই মধ্যে এলসিতে নতুন ক্লজ দিয়ে গেছে যে, স্যাংশন হলে পেমেন্ট তো দূরের কথা তারা গুডস নেবে না, গুডস দিলেও পেমেন্ট দেবে না । এই ক্লজে আমাদের ব্যাংক এলসি খুলবে না ।’

সম্প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বারা বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের বৈশ্বিক ক্রেতারা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের ক্রয় আদেশে নতুন শর্ত যুক্ত করেছেন। শিল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শর্তে তারা বলেছেন, এ ধরনের সম্ভাব্য কোনো নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হলে তারা পণ্য বা অর্থ প্রদানের দায়ভার গ্রহণ করবেন না।

এ শর্ত বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য একটি নেতিবাচক ধাক্কা; যা স্থানীয় রপ্তানিকারকদের অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ফারুক হাসান আরো বলেন, ‘একজন বায়ার (ক্রেতা) ইতিমধ্যে তাদের নতুন এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট)-তে এমন একটি ধারা যুক্ত করেছে যে, বাংলাদেশ যদি কোনো নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়, তাহলে তারা পণ্য নেবে না; বা যদি পণ্য চালানের পরে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হয়, তবে তারা ওই পণ্যের জন্য পেমেন্ট করতে সক্ষম হবে না।’

অনেকে বলছেন, বিজেএমইএ সভাপতির কথা থেকে ধরে নেয়া যায়, মার্কিন স্যাংশন দেওয়া হলে রাশিয়া-চীন বা ভারত ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রায় বিশ্বের সব দেশে রপ্তানির ঋণপত্র খোলা বন্ধ হয়ে যাবে ।

গত ৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। তার মতে, নিষেধাজ্ঞা এলে বিএনপির বিরুদ্ধে আসা উচিত। কারণ, তারা নির্বাচনে বাধা দিচ্ছে।

দেশের তৈরি পোশাক খাত নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে  অভিযোগ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিকদের নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করার একটা পাঁয়তারা আছে। এটা দেশেও আছে, বিদেশ থেকেও আছে। পরবর্তী সময়ে সরকারে আসতে পারলে শ্রম আইনের আরও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

তিনি বলেন, ‘কাজেই এ নিয়ে অযথা পানি ঘোলা করার কোনো কারণ নেই। এটা যারা করছে, তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এসব করছে।’