পুলিশি বাধা, ভয় উপেক্ষা করে মানববন্ধন ‘মায়ের ডাকের’

ছবি: বাংলা আউটলুক

প্রেসক্লাবের গেটের সামনে হই-হুল্লোড়, গাড়ি ডাকছেন, অ্যাম্বুলেন্স ডাকছেন, স্যালাইন গুলছেন কেউ। লং বেঞ্চে আফরোজা আখির কোলে লুটিয়ে পড়েছেন ষাটোর্ধ্ব নারী হাসিনা বেগম। পাশের চিকিৎসকদের কর্মসূচি থেকে দুজন এসে পালস চেক করলেন। সামনেই ক্যামেরা হাতে সাংবাদিকদের ভিড়। অনেক ডাকাডাকির পর নিউজ২৪ এর গাড়িতে ওঠানো হলো হাসিনা বেগমকে। তিনি গুম হওয়া তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রদলের সহসভাপতি তারিকুল ইসলাম ঝন্টুর মা। বরিশাল থেকে আজকে ঢাকায় আসছেন ‘মায়ের ডাক’র মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য।

আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর  আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এই দিবস উপলক্ষে ‘গুম-খুন, ক্রসফায়ার ও কারা নির্যাতনে হত্যার শিকার’ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ শাহবাগ জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে।

সকাল থেকেই কর্মসূচি শুরুর আগে পুলিশের ব্যাপক সদস্য উপস্থিতি হয়ে সভাস্থল ঘিরে ফেলে। সকাল ১১টায় আনুষ্ঠানিকভাবে মানববন্ধন শুরু করেন অংশগ্রহণকারীরা। ৫ বছর পূর্বে নিখোঁজ হওয়া ঈসমাইল হোসেন বাতেনের মেয়ে আনিসা ইসলাম ইনশি সূচনা বক্তব্য শুরু করার পর পুলিশ সদস্যরা মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নেয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা জোনের এডিসি সালমান ফারশির নেতৃত্বে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা  সভাস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য করেন মানববন্ধন অংশগ্রহণকারীদের।পরে পুলিশি বাধায় মানববন্ধনে  অংশগ্রহণকারীরা প্রেসক্লাবে গিয়ে পুনরায় কর্মসূচি শুরু করেন।

এই বিষয়ে রমনা জোনের পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. আক্তারুল ইসলামের বক্তব্য, ‘কর্মসূচির জন্য কোন অনুমতি নেওয়া হয়নি তাই তাদের কর্মসূচি করতে নিষেধ করা হয়েছে’।

মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করতে পঞ্চাশোর্ধ্ব আয়েশা আক্তার আসেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে ব্যানার খুলতেই দেয়নি, বলেছি আপনাদের সন্তান আছে, আমি ১০ বছর ধরে মা ডাক শুনি না। আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার। একমাত্র সন্তান আব্দুল কাদের মাসুমকে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে গুম করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আমার ছেলে খুব মেধাবী ছিল, সেনাবাহিনীর কমিশনার হওয়ার জন্য লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছিল। সেই ছেলেকে তারা গুম করেছে। আমার স্বামী বৃদ্ধ। পরিবার দেখাশোনার কেউ নেই।’

আয়েশা আক্তার, হাসিনা বেগমের মতো এ রকম শত পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করতে আসেন। কারো সন্তান গুম হয়েছে, কারো ভাই পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছে, কারো স্বামীকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে।

এ রকম ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের আর্তনাদে প্রেসক্লাবের আকাশ যখন ভারী তখন আইনশৃঙ্খলা পুলিশের সদস্যদের তর্জন-গর্জন। অংশগ্রহণকারী সদস্যদের নানা ধরনের হয়রানি করে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। সাংবাদিক সেজে তাদের বর্তমান ঠিকানা ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করছে।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময়ে গুম হওয়া খালেদ হাসান সোহেলের স্ত্রীর বাসার ঠিকানা নেন গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য। ফলে মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা নির্বিঘ্নে সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করতে পারেন না। একটি ভয়, আতঙ্ক ও থমথমে পরিবেশ তৈরি করা হয়।

‘মায়ের ডাক’র সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘ আমাদের ভাইরা, বোনদের স্বামীরা, মায়েদের নিখোঁজ সন্তানরা ফিরে না আসা পর্যন্ত রাজপথে দাঁড়াব। যাদের ক্রসফায়ারে, পুলিশি হেফাজতে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে তার বিচার নিশ্চিত করবে। আপনাদের বন্দুকে কত বুলেট আছে দেখব, আমরা আমাদের অধিকারের জন্য মরতে প্রস্তুত।’

মানববন্ধনে গুম হওয়া, ক্রসফায়ারে মৃত্যু, পুলিশি নির্যাতনে মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বিভিন্ন মানবাধিকার ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক তানিয়া রব, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সেক্রেটারি ফয়জুল হাকিম লালাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকেন।

সমাবেশে বক্তারা সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করার বিষয়ে সমালোচনা করেন। এবং বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের জেল-জুলুম দিয়ে একতরফা নির্বাচনের কড়া প্রতিবাদ জানান।