নির্বাচনের আগে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কপালের ভাঁজ ততোই বাড়ছে। পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় বেড়েই চলেছে। একদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাপ, অন্য দিকে মাঠে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তদের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থীদের শক্ত অবস্থান তাদের চিন্তিত করে তুলছে। পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশের একজন ডিআইজি ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের একান্ত আলাপে এ তথ্য উঠে এসেছে। তাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের বেশ কিছু নীল নকশা বাস্তবায়নের কৌশল। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যতটা সহজ মনে করেছিল সরকার, ততটা সহজ হচ্ছে না বলে মন্তব্য তাদের।

রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার ওই পরিচালক (পরিস্থিতির কারণে নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়) বলেন,  গোয়েন্দাসংস্থাসহ আইন শৃংখলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই সরকারের অনিয়মকে বৈধতা দিতে গিয়ে নিজেও অনিয়মের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে গেছেন। সন্তানের নামে বিদেশে বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন। সরকার পরিবর্তন হয়ে গেলে, এসব অনিয়মের খবর খুব সহজেই বেরিয়ে আসতে পারে। সে কারণে, সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনা ছাড়া তাদের উপায় নেই। আর সরকারের এই মিশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ওই সব কর্মকর্তারা গোটা বাহিনীকে নিজের মতো করে ব্যবহার করছেন। সম্প্রতি, বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে ধাবিত করতে রাষ্ট্রীয় এই গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে পুরনো কিছু বাস কিনে নিয়েছেন। ভাড়া করা লোকদের বিএনপি কর্মী সাজিয়ে বাসে আগুন লগিয়ে গণহারে বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আর এ কাজে সহায়ক হিসেবে নিয়েছেন পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা ডিবিকে। যদিও মতিঝিল জোনের ডিবির একজন এডিসি বলেছেন, যে প্রক্রিয়ায় কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে, তাতে দ্রুত তা নানাভাবে ফাঁস হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় ওই গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকতার পক্ষে এই কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে মাঠের নিয়ন্ত্রণ তদারকির জন্য জয়েন্ট ডিরেক্টর ও কয়েক জন এডি’র নেতৃত্বে বিশেষ চারটি টিম কাজ করছে।

তারাই বিএনপিসহ বিরোধী নেতাদের চিহ্নিত করে, আটক, গ্রেফতার ও তুলে নিয়ে সাদা কাগজে সই নিয়ে নির্বাচনে নেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে ডিবিকে দিয়ে। তাদের সেই মিশন অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। বিরোধী নেতাদের অনেকেই আটক-গ্রেফতার হলেও, নির্যাতনের মুখে কোনো স্বাক্ষর করেননি।

একই সঙ্গে, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দলের নেতাদের ম্যনেজ করে নির্বাচনে আনার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে একটি টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমু গণফোরাম নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টুকে ম্যনেজ করতে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত গিয়ে হাসপাতালে বৈঠক করেছেন, কিন্তু মন্টুকে রাজি করাতে পারেননি।

মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি, নুরুল হক নূরসহ কয়েকজন নেতাকে ম্যনেজ করার জন্য প্রলোভন, হুমকি ও আটকের ভয় দেখানো হয়। দলে ভেড়াতে ব্যর্থ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ফোনে আড়ি পেতে বা কণ্ঠ টেম্পার করে কেলেঙ্কারি রটানোর উদ্যোগ নেয় ওই গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতেও ব্যর্থ হয়েছে মিশন।

এরপরেও থেমে নেই, সরকার ঘনিষ্ট এই টিমের কর্মকাণ্ড। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা এখন ভোটের মাঠ উৎসব-মুখর করার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ ও নির্বাচনী সঙ্গীদের মাঠে প্রচার-প্রচারণায় নামানোর চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু এতেই বাঁধছে বিপত্তি। একদিকে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী, অন্য দিকে আওয়ামী লীগেরই ‘ডামি’ প্রার্থী। প্রত্যেকেই মনোনয়ন পেতে দলের সাধারণ সম্পাদক, গোয়েন্দা সংস্থা এমনকি প্রধানমন্ত্রী পরিবারের ঘনিষ্টদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত প্রতি আসনে নৌকার একজন এবং টাকা দেওয়া একাধিক প্রার্থীকে মাঠে রেখে দিয়েছে দলটি। যাতে একদিকে টাকা জায়েজ হয়, অন্য দিকে নির্বাচনী মাঠও সরগরম থাকে।

কিন্তু হয়েছে হিতে বিপরীত। দুই পক্ষই অনড়। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। প্রতিনিয়তই আওয়ামী লীগের দুই বা তিন পক্ষ বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে যে, পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোন পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক আসনে বর্তমান এমপি, বিদ্রোহী প্রার্থী বা ডামি প্রার্থী রয়ে গেছেন। প্রটোকল অনুযায়ী এমপির নির্দেশনা মানতে বাধ্য হতে হচ্ছে পুলিশ। আবার অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের জেলা বা কেন্দ্রের শীর্ষ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে রয়ে গেছেন। তাদের নির্দেশনা না মানলেও বিপদ। এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই দোটানায় পড়ে গেছেন।

পুলিশের ওই ডিআইজির মন্তব্য, অপকৌশল করতে করতে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হলে শেখ হাসিনাকে হয়তো দলের স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে। অন্যদিকে ফেয়ার নির্বাচনও দিতে হবে। এর ওপর জোট শরিকদেরও অনেকগুলো আসনে বিজয় নিশ্চিত করে দিতে হবে। কিন্তু মাঠে আওয়ামী লীগের ডামি বা বিদ্রোহী প্রার্থী কেউই ছাড় দিতে রাজি নয়। কারণ, তারাও টাকা দিয়ে নির্বাচনের মাঠে প্রার্থী হিসেবে বৈধতা পেয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের অনেক সদস্যই নির্বাচনের মাঠের দায়িত্ব পালনে ভয় পাচ্ছেন। অনেকেই ডিউটি করতে চাচ্ছে না। প্রকাশ্যেই অনেক পুলিশ সদস্য প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন। সরকারের মধ্যে আওয়ামী লীগ হারিয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন পুলিশের ওই ডিআইজি।

নাম প্রকাশ না করা ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, সরকারের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একটু শক্ত ধাক্কা দিলেই সরকার আর নির্বাচন শেষ করতে পারবে না।

অপর দিকে, সরকার ভেবেছিল নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসবে, বিরোধী দলের মাঠের আন্দোলনে সাড়া কমতে থাকবে। এমন গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে এগিয়ে যাচ্ছিল সরকার। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সচিব ছাড়া প্রায় সব কর্মকর্তারাই এর বিরোধিতা করে বিএনপিসহ আন্দালনরত রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনার ব্যপারে মত দিয়েছিল। কিন্তু দুটি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের একটি গ্রুপ এর বিরোধিতা করে সিইসিকে ধমক দিয়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করিয়েছেন। কিন্তু যে আশায় গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষকর্তারা এ কাজ করিয়েছেন, মাঠে ঘটেছে তার উল্টোটা।

সিপিবিসহ বাম অধিকাংশ দল, যারা আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাও এখন ধীরে ধীরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এই তফসিল বাতিল করে সব দলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে।

এ পরিস্থিতি সরকার আদৌ সামাল দিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষন করেছেন ওই দুই কর্মকর্তা। তারা বলেন, আদৌ এই নির্বাচন তোলা সম্ভব হবে কি না সন্দেহ আছে। যদি জোর করে নির্বাচন করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে দেশব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাংলাদেশের কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বা শেখ হাসিনা সরকারের নেই।