ডলারের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে ?

মোট দাগে বলতে গেলে বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে মার্কিন ডলারের দাম। ফলে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা টাকা মান হারাচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকার সমর্থিত রপ্তানিকারকরা রপ্তানি থেকে পাওয়া অর্থ ঠিক সময়ে ফেরত নিয়ে আসতে পারলে মার্কিন ডলারের দাম এতো বাড়ত না। অর্থাৎ পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পারলে বাজারে ডলারের দাম বাড়ত না। এখন খোলা বাজারে ডলার ১২৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ দামেও ডলার পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ব্যাংকে এক দিনেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে গেছে ৫০ পয়সা। চলতি অর্থ বছরের চার মাসে টাকার দরপতন হয়েছে ২ টাকা ৩০ পয়সা, আর এক বছরে কমেছে প্রায় ১০ টাকা।

২ নভেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১১১ টাকা। একদিন আগে বুধবারও এক ডলারে ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এ নিয়ে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে ষষ্ঠবারের মতো ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। অর্থ বছরের শুরুতে অর্থাৎ জুলাইয়ে ডলারের দাম ছিল ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা এবং এক বছর আগে গত নভেম্বরে ছিল ১০১ টাকা ৩৮ পয়সা।

নভেম্বরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানিকারকদের থেকে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় কিনে আমদানিকারকদের কাছে ১১১ টাকায় বিক্রি করবে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১৪ টাকা। অক্টোবরে ১১০ টাকায় ডলার কিনে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে। ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকায়। শিক্ষার্থী, রোগী ও পর্যটক বিদেশে যাওয়ায় সময় নগদ ডলার কিনতে গেলে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে।

ডলারের দাম টাকার বিপরীতে কমে যাওয়ার জন্য ভেতরের মূল কারণ হিসেবে আজ থেকে দুই বছর আগের ঘটনা কথা উল্লেখ করা যায় ।  ২০২২ সালে আগস্ট মাসের শেষে দেখা যায়, রপ্তানি হলেও ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে আসেনি। সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ৪৬ বিলিয়ান ডলার ফিরে আসে। কিন্তু ৯ বিলিয়ন ডলার ফিরে আসেনি। এতো বড় আর্থিক গ্যাপের কারণে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। তখন থেকেই ডলারের দাম বেড়ে গেছে ভয়ানকভাবে। তবে মনে করা হয়, অন্তত ৬ বিলিয়ন ডলার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, আমরা ভোটের আগে রপ্তানিকারকদের রপ্তানির টাকা ফেরত আনার বিষয়ে কোনো ধরনের চাপ দিতে চাই না। এখানে বলা রাখা ভাল, এ সব রপ্তানিকারকরা আওয়ামী লীগের সরকারের সুবিধাভোগী।

টাকার মান কমলে সমস্যা কোথায়?

ডলারের বিপরীতে টাকার মান যখন কমে যায় তখন বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারের চাপ বাড়ে। এক বছরে ডলারের দাম ১০ টাকা বেড়েছে, তার মানে আগের তুলনায় এখন বিদেশি ঋণ সরকারকে ১০ টাকা বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে ভর্তুকির পেছনে ব্যয় ও প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে।

মুদ্রার মান নির্ধারণ হয় অর্থের ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে। দ্রব্যের দামের সঙ্গে মুদ্রার মানের সম্পর্ক বিপরীত। দ্রব্যের দাম কমলে মুদ্রার মান বাড়ে, বিপরীত-ক্রমে দ্রব্যের দাম বাড়লে টাকার মান কমে। যেকোনো রাষ্ট্রের অর্থের আন্তর্জাতিক মূল্য নির্ধারিত হয় তার জোগান এবং চাহিদার ওপরে নির্ভর করে।

এদিকে ডলার সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।  ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার আকু অর্থ পরিশোধের পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হয়েছে মাত্র ১৯ বিলিয়ান মার্কিন ডলার। রিজার্ভ কমতে থাকলে টাকার মানও কমে যাবে। ডলার বাঁচাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। যদিও মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা এবং নিষ্পত্তির হার কমেছে। এতে উৎপাদন খাত শিথিল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেই চলেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ।

২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ (২৬ অক্টোবর) কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৭০ কোটি (২৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন) ডলারে। আন্তর্জাতিক হিসাবপদ্ধতি ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬) অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ৮৯ কোটি (২০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন) ডলার।

এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো কষ্টকর। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন নেতিবাচক। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।

গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি। দুই বছরে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। এক বছর আগে ১ ডলার কিনতে খরচ হয়েছে ৯৫-১০০ টাকা, ২ বছর আগে ৮৪-৮৬ টাকা। আর এখন ১ ডলার কিনতে হচ্ছে ১১০-১১৬ টাকা দিয়ে। ২ বছর আগে ১০০ ডলার কিনতে খরচ করতে হয়েছিল ৮৫০০ টাকার মতো। এখন ১০০ ডলার কিনতে খরচ হচ্ছে খোলা বাজারে প্রায় ১২,৪০০ টাকা। এই হিসাবে ২ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের প্রায় ৩০ শতাংশ পতন হয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভ একটা সময়ে ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। তখন আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগেছি। সঠিক ব্যবহার করিনি। কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম ধরে রেখেছিলাম। যা এখন আমাদের ভোগাচ্ছে। ডলারের বাড়তি মূল্য আমাদের মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিয়েছে। টাকার মান ধারাবাহিকভাবে কমছে। অর্থনীতিতে এগুলো এখন ‘ঘা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যা সারাতে না পারলে নিকট ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সাংবাদিকদের বলেছেন, ৩৬ বছরে চাকরি জীবনে আমি দেশের এমন খারাপ অবস্থা দেখিনি।

মহামারি করোনার আগের বছরগুলোতে বিশ্ববাজারে ঋণের সুদহার অনেক কম ছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণপ্রবাহও বেশ ভাল ছিল। একই সময় রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। এসব কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। এ নিয়ে বড় ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভোগে সরকার। রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়া হয় ২০০ মিলিয়ন ডলার। মালদ্বীপকেও ঋণ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া, রিজার্ভ থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঋণ নেওয়া হয় এবং উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়।

২০২১ সালের শেষ দিকে অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। তখন আমদানির চাহিদা বাড়ে। অন্যদিকে, রেমিট্যান্স কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে রিজার্ভে। এর মধ্যে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হয়। সংকট কাটাতে কঠিন শর্তে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে সরকারকে। এছাড়া ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানিতে নানা শর্ত আরোপসহ বিভিন্নরকম উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অল্প অল্প করে ডলার ছাড়া হয়েছে নিয়মিত। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না।