জাতীয় পার্টির প্যাঁচ

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের

জাতীয় পার্টি আবারও আলোচনায়।

সবার মনেই প্রশ্ন, জাতীয় পার্টি কি শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবে?

যদি দলটি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে তবে কি সরকার নির্বাচন করে ফেলতে পারবে?

দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে ডামি প্রার্থীদের পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা কতটা জমবে?

ওপরে ওপরে সবাই জানেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গে প্যাঁচটা লেগেছে আসন ভাগাভাগি নিয়ে।

শুধু জাতীয় পার্টি নয়।

১৪ দলের শরিকরা, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বিএসপি কেউই সরকারকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

তারা মনে করছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হলেও ডামি প্রার্থীরা মাঠে থাকলে তাদের জিতে আসা কঠিন হবে।

ডামিরাও আওয়ামী লীগের লোক, তারা ছলে বলে কৌশলে জিতে আসার চেষ্টা করবে।

দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে ডামিদের যদি সরানো না হয় তবে তাদের জিতে আসার সম্ভাবনা নেই।

এ কারণে জাতীয় পার্টি মনে করছে, আসন ভাগাভাগিটা পাকাপোক্ত করতে হবে।

তাদের দেওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বসিয়ে দিতে হবে।

এটা আওয়ামী লীগ মানতে চাইছে না।

তারা দলীয় মনোনয়নপ্রার্থীদের বসিয়ে দিতে আগ্রহী হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের দোহাই দিয়ে ডামিদের বসাতে চাইছে না।

এ নিয়েই চলছে দেন-দরবার।

নানা খবর থেকে জানা যাচ্ছে, জাতীয় পার্টিকে যত আসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তাদের চাওয়া তার থেকে অনেক বেশি।  

কিন্তু এ কারণে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সরকারের এত দিনের সমঝোতা হুমকির মধ্যে পড়বে?

এটা অবিশ্বাস্য।

দলটির সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়া অনেক দিনের।

বেগম রওশন এরশাদপন্থীরা তো বটেই, জিএম কাদের অনুসারীদের মধ্যেও অধিকাংশই সরকারপন্থী।

তারা সরকারের সুবিধাভোগী এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গেই থাকতে চায়।

তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কথা আলাদা।

তারা সাধারণ মানুষের মতো সরকারের ওপর বিরক্ত।

কিন্তু জাতীয় পার্টি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কথা শুনে চলা দল নয়।

এ অবস্থায় আলাপ-আলোচনা ও দেওয়া-নেওয়া, চাপ-তাপের প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসা সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়।

তাহলে প্যাঁচটা বাঁধছে কোথায়?

যতদূর জানা যাচ্ছে, অনেক বছর সাথে রাখলেও জাতীয় পার্টিকে সরকার আপদ হিসেবে দেখছে।

এরা কিছু না করে শুধু ৫ বছর পরপর নির্বাচন করে ঘিটা ও মাখনটা খেয়ে চলেছে।

এ অবস্থায়  সরকার চেয়েছিল জাতীয় পার্টিকে অগুরুত্বপূর্ণ করে তুলে তৃণমূল, বিএনএম ও বিএসপিকে বিরোধী দল হিসেবে গড়ে তুলতে।

কিন্তু এই দলগুলো বিএনপি নেতাকর্মীদের ভাগিয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার প্লান বি হিসেবে স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থীদের মাঠে নামায়।

নিজেরা নিজেরা প্রতিযোগিতা করে জিতে আসার পরিকল্পনা নেয়।

প্লান বি কার্যকর করার পর জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনার কৌশলও কার্যকর হয়।

কিন্তু এখনও প্লান এ অনুসারে জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল আছে। তৃণমূলদের ব্যর্থতায় সংসদের বিরোধী ভূমিকা নেবে ডামিরা।

কিন্তু জাতীয় পার্টি পুরনো সূত্রেই বোঝাপড়া করতে আগ্রহী।

এদিকে সরকার জাতীয় পার্টির ব্যাপারে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে।

এ অবস্থায় তারা জাতীয় পার্টিকে হ্যাঁ-ও করতে পারছে না, না-ও করতে পারছে না।

অগ্রগতি ছাড়াই আলোচনা চলছে।

এই আলোচনা ও নানা কথাবার্তায় জাতীয় পার্টি বুঝতে পেরেছে, এবার তারা প্রধান বিরোধী দল হতে পারবে না।

তার চেয়েও বড় কথা, জিএম কাদের ও তার প্রতি অনুগতদের সংসদে আসতে দেওয়া হবে না সরকারের এমন একটি মনোভাবের কথাও তারা জানতে পেরেছে।

এটা জেনেই জাতীয় পার্টি নানামুখি দেন-দরবার বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে।

তারা প্রধান বিরোধী দল হতে তো চায়-ই, ৫০-৭০ আসন নিয়ে সংসদে আসতে আগ্রহী।

আর জিএম কাদেরসহ তার অনুসারীদের বিজয়ও নিশ্চিত করতে চায়।

এই কঠিন দেন-দরবারে বিরক্ত হয়ে সরকার পক্ষ বলা শুরু করেছে, জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে নাও আসতে পারে। তাদের বিশ্বাস নেই।

কথা শুনে মনে হতে পারে, সরকার তাদের ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

কিন্তু, সরকারের জন্য যে কোনো মূল্যে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে রাখার চেষ্টা করাই তো স্বাভাবিক। কয়দিন আগেও তাদের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করে নির্বাচনে আনা হয়েছে।

এখন কেন তারা বোঝাতে চাইছে, জাতীয় পার্টি না এলেও কিছু আসে যায় না? ৫০-এর জায়গায় ৪০ আসনে সমঝোতা করলে অসুবিধা কী?

নাকি সরকার ভাবছে, এখনও জিএম কাদেরকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

কেউ কেউ বলছেন, সরকার এখন চায় জাতীয় পার্টি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াক।

ডামি প্রার্থীদের নিয়ে সরকারের চিন্তা বাড়ছে।

বড় কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না থাকলে ডামি প্রার্থীরা জিতলে আপাতত কোনো সমস্যা নেই।  

ডামিরা নিজেরা সংগঠিত হতে পারবে না।

কিন্তু জাতীয় পার্টির সঙ্গে ৫০ আসনে সমঝোতা করলে একটা বড় ঝুঁকি থেকে যাবে।

এখন পর্যন্ত নানা সূত্র থেকে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ৮০ থেকে ১৩০টি আসনে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারে।

জাতীয় পার্টি বেশি সংখ্যক আসনে বিজয়ী হলে ডামি বা স্বতন্ত্রদের সমর্থন নিয়ে তারা সরকার গঠন করতে পারে।

অন্য ছোট দলগুলো উপযুক্ত সময় পেলে জাতীয় পার্টিকে সমর্থন দেবে না এমন নিশ্চয়তাই বা কোথায়?

সব ঠিক থাকলে, ৭ জানুয়ারী নির্বাচন হলে যে সংসদ গঠিত হবে তাতে শেখ হাসিনার পর একমাত্র জাতীয় নেতা থাকবেন জিএম কাদের।

ভারতের কাছে তিনি খুবই গ্রহণযোগ্য।

আন্তর্জাতিক যোগাযোগও ভাল তার।

মন্ত্রী ছিলেন।

তার নেতৃত্বে সংসদীয় ক্যু হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

গত কয়েক বছরে সরকার যে শুধু বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা-সাজা দিয়ে তাদের নির্বাচনের অযোগ্য করেছেন তা-ই নয়।

তারা জামায়াত-হেফাজতকেও নেতৃত্ব শূন্য করেছে। আওয়ামী লীগের ভেতরের জাতীয় নেতাদের সবাইকে কোণঠাসা করে একেবারে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে।

দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোনো জাতীয় নেতা আর অবশিষ্ট নেই।

বিএনপির জাতীয় নেতাদের অনেকে নির্বাচনে আসার অনুপযুক্ত হয়েছেন, বাকীদের অনুপযুক্ত করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে।

এ অবস্থায় জিএম কাদেরকে সংসদের বাইরে রাখার চেষ্টা করা খুবই স্বাভাবিক।

তাহলে জাতীয় পার্টি নিয়ে কী ঘটবে?

সম্ভবত, জিএম কাদেরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে রাখা হবে।

আদালতের আদেশের মাধ্যমে রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ফিরলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

তাতে জাতীয় পার্টি, ছোট দল ও ডামি প্রার্থীদের নিয়ে সরকারের ভয় কমলেও পুরোপুরি যাবে না। এরা সংগঠিত হয়ে সরকার গঠন করতেই পারে। সেক্ষেত্রে এদের সংখ্যা ১০০ আসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেই হবে।

নৌকার এমপি ২০০ রাখতে হবে।

আর সেটি করতে হলে বড় ধরনের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে হবে।

নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে না।

অবশ্য সেটা সরকারের জন্য বড় সমস্যা হবে না।

তারা লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েই মাঠে নেমেছে। এগুলো তাদের জন্য কোনো সমস্যাই না।