জমল না প্রার্থী কেনাবেচার হাট

ছবি: বাংলা আউটলুক

একতরফা নির্বাচনকে লোক দেখানো বৈধতা দিতে সরকারের প্রস্তুতি ছিল প্রার্থী বেচাকেনার হাট জমিয়ে তোলার। কর্মীবিহীন নাম সর্বস্ব দলের নেতাদের পকেটে পুরতে উদয়াস্ত খেটেও সুবিধা করতে পারেনি সরকারি দলের আজ্ঞাবহ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। যদিও মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমকে পাওয়ার পর মনে হচ্ছিল বড় বড় রুই-কাতলারা হয়তো গিলবে সরকারি টোপ। তবে সুবিধা হয়নি খুব একটা। জানা গেছে, সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে আরও দুটি দলকে জুড়ে দিয়ে কেনা হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি টাকায়।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জেনারেল ইব্রাহিমসহ যুক্তফ্রন্ট নামের ওই জোট এরই মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জেনারেল ইব্রাহিম সংবাদ সম্মেলন করে তফসিল পেছানোর কথা বলেছেন। এদিকে, অন্তত দুজন নির্বাচন কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিনিধিকে বলেছেন, নির্বাচনের তারিখ অন্তত এক সপ্তাহ পেছানো হবে। কারণ বিএনপিকে চাপ দিয়ে যদি শেষ পর্যন্ত আনা যায় সেটি ভালো। না হলে অন্য সব ছোট ছোট নেতাদের কেনা-বেচায় বাড়তি ওই সময়টুকু লাগবে।

জানা গেছে, বরাবরের মতো নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আসতে বাধ্য করেছে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি গেল ১৪ নভেম্বর বৈঠক করে একতরফা নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিলেও ২২ নভেম্বর সেই সিদ্ধান্ত উল্টে গেছে। জাতীয় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) একটি সশস্ত্র দল ওইদিন জি এম কাদেরকে বাসা থেকে তুলে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়ে যায় বলে খবর আছে। একই দিনে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) একটি দল একই হোটেলে তুলে নিয়ে আসে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে। জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, মনোনয়ন বিক্রি, আসন ভাগ-বাটোয়ারার আলোচনা ছাড়াও নগদ ৫০ কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে ওই দুই নেতাকে। এর মধ্যে জিএম কাদেরকে ৩০ কোটি এবং চুন্নুকে ২০ কোটি টাকা দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে নির্বাচন নিয়ে অন্য পথে হাঁটলে ওই টাকা আর অবৈধ অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো হবে তাদের। এরপরই ডিবির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন চুন্নু। যদিও জাতীয় পার্টি নাটকের অনেকখানি এখনো বাকি আছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ রওশন এরশাদ আর মসিউর রহমান রাঙ্গা এখনো বেঁকে বসে আছেন। কেনা-বেচার হাটে তাদের দাম না ওঠায় নাখোশ তারা।

নির্বাচনে যাবেন না বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন রওশন এরশাদ। জাতয়ি পার্টির নাটক কোথায় গিয়ে শেষ হয় বলা মুশকিল।

পূর্বঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর)। মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় নির্বাচন কমিশন আর বাড়াবে কি না তা সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জানা যায়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো আভাস পাওয়া যায়নি।

এ ছাড়া সিপিবি, বাসদ, ইসলামি আন্দোলন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাসদ রব, নাগরিক ঐক্য, গণতন্ত্র মঞ্চের সব দল, খেলাফত মজলিসসহ অনেক পরিচিত দল নির্বাচনে বর্তমান অবস্থায় আসছে না বলে জানিয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে নানা চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ চলছে। দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের জেলে রেখেই সরকার তাদের চাপ দিচ্ছে নির্বাচনে আসার। চাপে কাজ না হওয়ায় নিশ্চিত জামিনও আটকে গেছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। চাপের অংশ হিসেবে সারা দেশে চলছে র‌্যাব-পুলিশের অঘোষিত ‘ক্র্যাকডাউন’। প্রায় প্রতিদিনই গায়েবি মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে বিএনপির এক থেকে দেড় শ নেতাকে। গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে অনেককে।

ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানাচ্ছেন. গত এক মাসে বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২ মাসে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অন্তত ৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে সাজা দেয়া হয়েছে। কারও কারও ৬ মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়েছে।

এরই মধ্যে সোমবার এক নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসতে চাইলে নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তন করার বিষয়টি ভেবে দেখবেন। এর একদিন পরেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে নির্বাচনের তারিখ ঠিক রেখে তফসিল পরিবর্তন করবে, তাতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই। সরকারও বিদেশিদের কাছে সব দলের অংশগ্রহণ দেখাতে মরিয়া বলে এমনটা ভাবছে নির্বাচন কমিশন। কারণ বিদেশিদের কাছে এই সরকার দেখাতে চায় বিএনপি ছাড়া দেশের প্রতিটি দল নির্বাচনে এসেছে। এমনকি বিএনপির অনেক নেতাকেই টোপ দেওয়া হচ্ছে স্বতন্ত্র নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে এমপি বানিয়ে আনার।

গত সোমবার নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, ওনারা যদি আসেন আমরা কমিশনাররা বসব, আইন-কানুন দেখব, তারপর যেটা সিদ্ধান্ত হয় সেটা করব। আমরা তো চাই সব দল এসে একটা সুন্দর ইলেকশন হোক।

বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনের বিষয়টা অ্যাবসলিউটলি নির্বাচন কমিশনের বিষয়। সময়সীমা ঠিক রেখে তারা যদি কোনো অ্যাডজাস্টমেন্ট করে সেটা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার। আমাদের কিছু বলার নেই। এমনকি এ প্রতিবেদককে অন্তত দুজন নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, তফসিল এক সপ্তাহ পিছিয়ে সব তৈরি করা আছে। সরকারের সিগন্যাল পেলে সেটি করাও হতে পারে। যদিও তারা এ বিষয়টি নিয়ে এর বেশি আর কিছু বলতে চাননি। বলেছেন-সময় আসলেই দেখবেন। তবে অনেক কিছুই হয়তো ধারণার বাইরে ঘটবে।

আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা এই প্রতিবেদককে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সরকারের ভয় বিএনপিকে নয়। সরকার সত্যিকারেই ভয় পায় জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোকে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলই থাকছে দর কষাকষিতে না মেলায়। কিন্তু তলে তলে অনেক নেতার সাথে আলোচনা চলছে স্বতন্ত্র বা অন্য প্ল্যাটফর্ম থেকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার। এ ছাড়া আরও কিছু ইসলামিক দল ও জোটকে নিয়ে ভয় ছিল যারা একতরফা নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদেরও বেশিরভাগ ম্যানেজ হয়ে গেছে। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দফা-রফা করেছেন ৯টি ইসলামিক দলের শীর্ষ ১৪ নেতা। রাজনৈতিক দলগুলো হলো, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, আশেকানে আউলিয়া ঐক্য পরিষদ এবং জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

মূলত একতরফা নির্বাচনকে বহির্বিশ্বের কাছে জায়েজ ও বিএনপিকে একঘরে করে কোণঠাসা করে রাখার সব আয়োজনই চূড়ান্ত। বিএনপিকে চরম সিদ্ধান্তহীন ও নেতা-কর্মীদের বিচ্ছিন্ন রেখে ঘোরের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন উঠিয়ে নিতে নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একাট্টা হয়ে কাজ করছে। এখন একটি জিনিসই শুধু বাকি-ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ভারতে ছুটে যান সে কাজটিই করতে। আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলে আগামী পাঁচ বছরে ভারতকে কী কী উপহার দেবে বাংলাদেশ, মূলত তার ডালা সাজিয়েই তৈরি করা হয়েছে তার এ সফরসূচি।

রাজনৈতিক মহলের অনুমান, ভারতের কাছ থেকে সিগন্যালটি মিললেই আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবেন শেখ হাসিনা। যার দৃশ্যমান ফলাফল দেখবে বাংলাদেশের মানুষ ও পুরো বিশ্ব।