পাতানো নির্বাচন, সাজানো খেলা

পাতানো নির্বাচন, সাজানো খেলা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেনতেনভাবে পার করতে একাট্টা সরকারি দল আওয়ামী লীগ। তার হাতে হাত রেখে ভবিষ্যত ভাগ-বাটোয়ারার দেশ পরিচালনায় একাট্টা প্রশাসন থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গেল সতেরো বছরে ভোটাধিকার হারানো মানুষ এবার সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের প্রত্যাশা করে আসলেও সে আশায় গুড়েবালি। যেভাবেই হোক গদি না ছাড়ার আওয়ামী লীগের কৌশল দেশের মানুষকে শুধু হতাশ করেনি, গণতন্ত্রকেও অন্ধকারে ঠেলেছে। দেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ কথা বলাই যায় যে দেশের ষোল কোটি মানুষ এই দুই মতাদর্শের রাজনৈতিক আদর্শে ও চেতনায় বিশ্বাসী। বড় এই দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোন নির্বাচনে দেশের মানুষের সঠিক মতামতের প্রতিফলন হয়েছে তা কোনভাবেই বলা যায় না। কারন মোট জনসংখ্যার সমান আরেকটি ভোট ব্যাংক এবং সিদ্ধান্তহীন ভোট ব্যাংকের মানুষগুলোর মতামত জানানোর উপায় তাহলে কোথায়? যদি নির্বাচনটি কথিত নিরপেক্ষও হয় তাহলে ওই মানুষগুলোর মতামত জানানোর পদক্ষেপ দৃশ্যত চোখে পড়েনি।

এই একতরফা সাজানো নির্বাচনকে ঘিরে গেল এক দেড় বছর ধরেই চলছে নেতা বেচাকেনার হাট। একদিকে যেমন চলেছে বেচাকেনা তেমনি কাজে লাগানো হয়েছে চাপ প্রয়োগের কৌশলও। মামলা, হামলা হুমকি কোন কিছুই বাদ যায়নি এ থেকে। কিন্তু কথিত দু’তিনটি ‘রাজদল’ বা কিংস পার্টি নামকাওয়াস্তে গঠন করে তাদের নির্বাচনের পাতানো খেলার মাঠে নামালেও আসল খেলোয়াড়দের ঠেলে রাখা হয়েছে দূরে। এর মধ্যেই গেল কয়েকদিনে যে নাটকীয়তা দেখেছে জাতি তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আগামী নির্বাচন পাতানো, খেলা চলছে সাজানো। এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থীকে থানায় নিয়ে আটকে রেখে হুমকি ধামকি দেয়ার মতো ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে পছন্দের সাজানো প্রার্থীর পথকে কন্টকমুক্ত করতে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি তো স্পষ্টই বলে দিয়েছে কোন মতেই এই নির্বাচনকে অংশগ্রহনমূলক ও সার্বজনীন বলা যায় না। সে সংক্রান্ত গণমাধ্যমের দুটি প্রতিবেদন পাঠকদের জন্য হুবহু এখানে তুলে দেয়া হলো। এই নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ যে থাকবেনা সেটি বলাই যায়।

মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের রাতে দুই ঘণ্টা প্রার্থীকে থানায় রাখল পুলিশ

দিনাজপুর-৩ (সদর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করার আগের রাতে আওয়ামী লীগ নেতা বিশ্বজিৎ ঘোষ ওরফে কাঞ্চনকে থানায় নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে প্রার্থী না হতে চাপ দিতেই গত বুধবার মধ্যরাতে তাঁকে বাসা থেকে পুলিশের গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা যুবলীগের সভাপতি রাশেদ পারভেজও মনোনয়নপত্র জমা না দিতে হুমকি পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দিনাজপুর-৩ আসনে আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বজিৎ ঘোষ ও রাশেদ পারভেজ রাজনৈতিক জীবনে বেশির ভাগ সময়ই হুইপ ইকবালুর রহিমের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে গত চার বছরের বেশি সময় ধরে ইকবালুর রহিমের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব চলছে।

পুলিশ ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে শহরের বড়বন্দর এলাকায় নিজ বাসভবন থেকে পুলিশ একটি গাড়িতে করে বিশ্বজিৎ ঘোষকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে আসেন। পরে রাত সোয়া ২টার দিকে তাঁকে আবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিশ্বজিৎ ঘোষ। তিনি দিনাজপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর বিশ্বজিৎ ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, ‘দলীয় প্রধান (শেখ হাসিনা) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো বাধা রাখেননি। আমার জনপ্রিয়তায় কেউ ঈর্ষান্বিত হতে পারে। মনোনয়ন ফরম কেনা থেকে জমা দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু দিনাজপুরের সাধারণ মানুষের ভালোবাসাকে আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের যাত্রায় সহযাত্রী হয়ে দিনাজপুরের অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।’

থানায় তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘সাংবাদিকরা বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ রাখেন। কেন পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে গেল এই প্রশ্নের উত্তর আপনারাই খুঁজে বের করেন।’

এ বিষয়ে দিনাজপুর কতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ হোসেন বলেন, ‘কুশল বিনিময় করার জন্য তাঁকে (বিশ্বজিৎ ঘোষ) ডাকা হয়েছিল। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় যেন কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়, সে জন্য তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। অন্য কোনো কারণ নেই।’

বুধবার দিবাগত রাত পৌনে ১২টায় বিশ্বজিৎ ঘোষকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর কর্মী বজলার রহমান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এরপর রাত সাড়ে ১২টায় বিশ্বজিৎ ঘোষ ফোনে জানান, ‘বাসার সামনে চারজন পুলিশ এসে ডাকাডাকি করছে। গাড়ি নিয়ে এসেছে।’ মিনিট দশেক পরে তিনি আবার ফোন দিয়ে থানায় আসতে বলেন। বজলার রহমান বলেন, ‘থানায় এসে দেখি টি শার্ট ও লুঙ্গি পড়া অবস্থায় দাদাকে থানায় ওসির রুমে নিয়ে এসেছেন। আমাদের কয়েকজনকে বের করে দেন। রাত সাড়ে ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কথা বলে। সে সময় ওসি ফরিদ হোসেন ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শেখ জিন্নাহ আল মামুন কক্ষে বসা ছিলেন। পুলিশ নিজের গাড়িতে সোয়া দুইটার সময় বাসায় নামিয়ে দেন।’

বজলার রহমান আরও বলেন, পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার কারণের বিষয়ে তিনি বিশ্বজিৎ ঘোষের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁকে জানিয়েছেন, নানা কথাবার্তা হয়েছে। তবে পুলিশ তাঁকে বলেছে, নির্বাচন থেকে দূরে থাকাই ভালো। এগুলো ঝুট-ঝামেলার মধ্যে জড়াইয়েন না। বজলার রহমানের দাবি, পুলিশ বাসার সামনে বিশ্বজিৎ ঘোষকে নামিয়ে ফেরার সময় বলছিলেন, ‘বুঝেন তো সবকিছু। আমরা না চাইলেও অনেক কিছু তামিল করতে হয়। আপনি কিছু মনে করবেন না।’

স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর জেলা যুবলীগের সভাপতি রাশেদ পারভেজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যায় আমার কাছে ফোন আসে যে সাধুরঘাটে একটা মিটিং চলছে। আমি যেন সাবধানে মনোনয়ন ফরম জমা দিতে আসি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে, তারা হয়তো মনে করছে দিনাজপুরে তাদেরই লোকজন আছে। আসলে এটা ভিত্তিহীন। আমরা যারা রাজনীতি করি, প্রত্যেকের সঙ্গেই জনবল আছে।’

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, তা দেখা যাচ্ছে না : টিআইবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, তফসিল ঘোষণার আগে ও পরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এ পর্যবেক্ষণে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে যে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, তা আমরা এবারও দেখতে পাচ্ছি না।

বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হয়ত এই নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে ক্ষমতায় কারা অধিষ্ঠিত থাকবেন সেটিও নির্ধারণ করার সুযোগ হবে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটের অধিকারের যে নির্বাচন সেটি নিশ্চিত করা যাবে না। এই নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা বা ভোটের ওপর জনগণের আস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব হবে বলে মনে করি।

প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বে বহাল থাকায় নির্বাচনে দলীয় বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, স্বার্থের দ্বন্দ্ব মুক্ত ভূমিকা পালন করার জন্য। যখন একটি দল ক্ষমতায় নির্বাচিত হয়, সেই দলটি দেশের সরকার হিসেবে নির্বাচিত হয়। তখন সেই সরকার আর কোনো দলের সরকার থাকে না। কিন্তু সেই সরকারের সরকার প্রধান যদি স্বপ্রণোদিতভাবে দলীয় নেতৃত্বের অবস্থান থেকে পদত্যাগ করেন, তাহলে প্রতিকী অর্থে হলেও সবার সরকার প্রধান হিসেবে বা সব দলের সরকার হিসেবে নিজেকে তার ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, সংসদের স্পিকারের ক্ষেত্রেও একই কথা। স্পিকার যখন নির্বাচিত হন তখন আর কোনোদলের প্রতিনিধি থাকেন না। তখন তিনি সব এমপির স্পিকার। প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের ক্ষেত্রে এই দুই বিষয় নিশ্চিত করতে পারলেই স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ভূমিকা অর্জন করা সম্ভব। এই পরামর্শগুলো আমরা আজকে নতুন দিচ্ছি না... ২০০৮ সালেও আমরা একই পরামর্শ দিয়েছি। সেসময় নির্বাচনের পরেও আমরা এই পরামর্শ দিয়েছিলাম, তবে কাজ হয়নি। তা সত্ত্বেও আমরা এই পরামর্শগুলো দিয়ে যাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার চর্চার রাজনৈতিক অঙ্গীকারের লক্ষ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ৭৬ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে টিআইবি।