কারাগারে বাড়ছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু

কারাগারে বাড়ছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু

দেশে কারাবন্দী বিএনপি নেতা-কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত সপ্তাহে কাশিমপুর কারাগারে ৬ দিনের ব্যবধানে দুই বিএনপি নেতার মৃত্যু মানবাধিকার কর্মীদের ভাবিয়ে তুলেছে। এসব মৃত্যুর বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হচ্ছে কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচনের আগে কারাগারে নেতাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু বেড়ে যাওয়াকে অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেফতার হওয়ার আগে বার বার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের জোরপূর্বক ব্যবহার এবং গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন।

এদিকে, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য ইমতিয়াজ হাসান বুলবুলের মৃত্যুর অভিযোগ করেছে তার পরিবার। নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, বুলবুলকে গত ২৪শে নভেম্বর আটক করে নিয়ে যায় ওয়ারী থানা পুলিশ। এরপর তাকে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ছয় দিনের ব্যবধানে বিএনপির দুই নেতার মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা দুজনই গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর মধ্যে একজন শুক্রবার ১ ডিসেম্বর দুপুরে মারা যান। আসাদুজ্জামান হিরা খান (৪৫) নামের ওই ব্যক্তি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এ বন্দী ছিলেন। শুক্রবার সকালে বুকে ব্যথা শুরু হলে তাঁকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জ্যেষ্ঠ জেল সুপার আমিরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আসাদুজ্জামান হিরা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের ধামলই গ্রামের গিয়াস উদ্দিন খানের ছেলে। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, আসাদুজ্জামানকে বিস্ফোরক মামলায় ২৯ অক্টোবর গাজীপুর জেলা কারাগারে নেওয়া হয়। পরে ১০ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগারে আনা হয়।

জ্যেষ্ঠ জেল সুপার আমিরুল ইসলাম বলেন, ময়নাতদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া শেষে আসাদুজ্জামানের লাশ তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আক্তারুল আলম বলেন, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে বিকেলে ট্রেনযোগে শ্রীপুর রেলস্টেশনে এসে নামেন আসাদুজ্জামান। এ সময় শ্রীপুর থানার পুলিশ তাঁকে আটক করে। পরে তাঁর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। আক্তারুল আলম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, কেবল রাজনৈতিক কারণে সুস্থ একজন মানুষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। এরপর তাঁর এমন মৃত্যু খুবই দুঃখজনক।

এর আগে গত শনিবার কাশিমপুর কারাগারে বন্দী চট্টগ্রামের বিএনপির এক নেতা মারা যান। ওই ব্যক্তির নাম গোলাপুর রহমান (৬৩)। তিনি চট্টগ্রাম মহানগরের চান্দগাঁও থানাধীন চর রাঙ্গামাটিয়া এলাকার মৃত আবদুল মিয়ার ছেলে। তিনি চট্টগ্রাম মহানগরের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, চান্দগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি ও মোহরা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ আজম, গোলাপুর রহমানসহ সাতজনকে ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশের আগের দিন সন্ধ্যায় পল্টনের বিএনপি অফিসের সামনে থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। এর পর থেকে তাঁরা কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন।

কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, কারাগারের ভেতর অসুস্থ হয়ে পড়েন গোলাপুর রহমান। তাঁকে উদ্ধার করে কারা হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। পরে তাঁকে কারা অ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পাঠানো হয়। সেখানে নেওয়ার পর চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে পল্টন থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা ছিল।

শনিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে এক কর্মকর্তা গোলাপুর রহমানের ছেলেকে টেলিফোনে তাঁর মৃত্যুর খবর দেন। লাশ আনার জন্য ঢাকায় যেতে বলেন। ওই কর্মকর্তা জানান, বেলা দুইটার দিকে তিনি অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মোহাম্মদ লুৎফর রহমান আইনি প্রক্রিয়া শেষে গোলাপুরের লাশ তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তরের কথা জানান।

এদিকে, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য ইমতিয়াজ হাসান বুলবুলের মৃত্যুর অভিযোগ করেছে তার পরিবার। নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, বুলবুলকে গত ২৪শে নভেম্বর আটক করে নিয়ে যায় ওয়ারী থানা পুলিশ। এরপর তাকে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে তাকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় হঠাৎ কারা কর্তৃপক্ষ তাকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গত ২৬শে নভেম্বর ভর্তি করান। পুরো বিষয়টি পরিবারের কাছে গোপন রাখে পুলিশ। ৩০শে নভেম্বর বৃহস্পতিবার তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায়  মৃত্যুবরণ করলে পরিবারকে জানানো হয়।

তার ভাগ্নে ও আরেক আত্মীয় স্থানীয় যুবলীগ ও তাঁতী লীগ কর্মীর তত্ত্বাবধানে মরদেহ হস্তান্তর করে পুলিশ। মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে রাত ৯টায় চুপিসারে দাফন কাজ সম্পন্ন করে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মৃত বুলবুলের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে বলে পরিবারের দাবি।

বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন অভিযোগ করেন, গত ২২ অক্টোবর প্রথমে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা বুলবুলের পকেটে জোর করে গাজা ঢুকিয়ে দিয়ে ওয়ারী থানার পুলিশকে খবর দেয়।

পুলিশ এলে তাদের হাতে তাকে তুলে দেয়। সেদিন পুলিশ তাক ছেড়ে দিলেও ২৪শে অক্টোবর ওয়ারী কাজী আরিফ স্কুলের সামনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা বুলবুলকে মারধর করে আবারও পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপর তাঁকে থানায় অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এসময় পরিবারের সদস্যরা তাকে দেখতে গেলে তাদের দেখতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে বুলবুলের খোঁজে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে একাধিকবার গেলেও তার হদিস পাননি। গত ২০ তারিখে পরিবার নিশ্চিত হয় বুলবুল কাশিমপুর কারাগারে আছেন। এরপর সেখানে গিয়েও বুলবুলের সাথে দেখা করতে পারেনি- তার পরিবারের সদস্যরা। ২৪ নভেম্বর বুকের ব্যথায় পড়ে গেলে বুলবুলকে নেওয়া হয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে। পুরো বিষয় পরিবারের কাছে গোপন রাখা হয়েছিলো। বৃহস্পতিবার তিনি মৃত্যুবরণ করলে পরিবারকে জানানো হয়।

বৃহস্পতিবার ভোর তিনটা ২০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বুলবুলকে মৃত্যু ঘোষণা করার পর থেকেই লাশ পুলিশের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। এরপর নিহত বুলবুলের ভাগিনা শ্যামল ও পলাশ (স্থানীয় তাতী লীগ নেতা)-এর কাছে লাশের বিষয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতে চাইলে তারা দিনভর এলোমেলো তথ্য দেন। বলেন,  লাশ দাফন হয়ে গেছে, মর্গে আছে, পুলিশের কাছে আছে। পরে রাত ৯টায় চুপিসারে দাফন কাজ সম্পন্ন করে পুরো বিষয় ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে।

যদিও ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান এই নামে কোনো বিএনপি নেতাকে আমরা আটক কিংবা গ্রেপ্তার করেননি বলেই গণমাধ্যমকে জানান। তাহলে কে তাকে কাশিমপুর পাঠালো আর কিভাবে মৃত্যু হলো এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি তিনি।

নির্বাচনকে সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে বিএনপি নেতাদের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে উদ্বিগ্ন মানবাধিকার কর্মীরা। এসব ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন তারা। এছাড়া সামনে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এসব ঘটনা এমন সময় বাড়ছে যখন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক কান্ট্রি রিপোর্টে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনা করেছে।