কওমি ধারার দলগুলো নেই নির্বাচনে

ছবি: সংগৃহীত

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম সরকারের সঙ্গে সখ্য রেখে চলছে-এমন খবর থাকলেও, একই ধারার ইসলামি দলগুলো ঘোষিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্বাচন বর্জন করেছে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক চারটি প্রধান দলই এ নির্বাচন অংশ নিচ্ছে না। দলগুলো বিএনপির মতো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়।

সরাসরি সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও হেফাজতের সঙ্গে আদর্শগত সম্পর্ক রয়েছে চরমোনাইয় পিরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের। নিবন্ধিত বাকি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং খেলাফত আন্দোলন সরাসরি হেফাজতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ দলগুলোর নেতারা হেফাজতেও পদে রয়েছে। এক সময়ে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারাও ছিলেন হেফাজতের কমিটিতে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোট নির্বাচনে গেলেও বর্জন করেছে, জমিয়ত এবং খেলাফতের দুই অংশ। এ তিন দলের দেশের কয়েকটি আসনে ভোট ব্যাংক  রয়েছে। সে তুলনায় খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোট দুর্বল। দল দুটি ঢাকার দুই মাদ্রাসা কেন্দ্রিক।

জমিয়ত এবং দুই খেলাফতের নেতারা জানিয়েছেন, ভোটে অংশ নিতে চাপ থাকলেও, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। এই দলগুলো এক সময়ে বিএনপি জোটে ছিল।

কারাবন্দী হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ২০০৬ সালে বিএনপির জোট ছেড়ে স্বল্প সময়ে জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে। গত নির্বাচনে জোট করেছিল জাতীয় পার্টির সঙ্গে।

জানা গেছে, ভোটে অংশ নিলে মামুনুল হককে জামিন ও আর্থিক সহয়তার প্রলোভন থাকলেও দলটি নির্বাচন বর্জন করে।

২০২১ সালে হেফাজতের কর্মসূচিতে সহিংসতার মামলায় কারাগারে যান জমিয়ত ও খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতারা। এরপর এ দুই দল বিএনপির জোট ছাড়ে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জমিয়তের সহ-সভাপতি সাবেক এমপি শাহীনূর পাশা চৌধুরীও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। বিএনপি জোটের সাবেক এই এমপি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সুনামগঞ্জ-৩ আসনে। তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে জমিয়ত।

দলের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি বলেছেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড় রয়েছে জমিয়ত। কোনো প্রলোভনেই টলবে না।

ছয় দলের জোট ‘সমমনা ইসলাম দলসমূহ’ ছেড়ে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) এবং খেলাফত আন্দোলন নির্বাচনমুখী হলেও, খেলাফত মজলিস মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের বলেছেন, পাতানো নির্বাচনে গিয়ে জাতীয় বেইমান হতে চান না।

ধর্মভিত্তিক দলের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে সহায়তা করা এবং প্রত্যেক দলকে তিন কোটি টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব ছিল সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফে।

তা গ্রহণ করা হয়নি জানিয়ে একজন নেতা বলেছেন, যেসব দল এক মাদ্রাসাকেন্দ্রিক, সংগঠন এবং কর্মী নেই, তারাই নির্বাচনে যাচ্ছে। কারণ তাদের জবাবদিহি নেই। জমিয়ত ও খেলাফত ছোট দল হলেও সারাদেশে কয়েক লাখ করে ভোট রয়েছে। নির্বাচনে গেলে তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আখেরে দল বিলুপ্ত হবে। যেসব দল নির্বাচনে যাচ্ছে, তাদেরও কেউ এমপি হতে পারবে না।

ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবুল হাসানাত আমিনীর প্রয়াত বাবা মুফতি ফজলুল হক আমিনী বিএনপি জোটের মনোনয়নে ২০০১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে আবুল হাসানাত একই আসন থেকে জয়ী হতে সহায়তা কামনা করেন। ওই আসনের বর্তমান এমপি শাহজাহান সাজুকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করায় আবুল হাসানাত আমিনীর চাওয়া পূরণের সম্ভাবনা প্রায় মুছে গেছে।

ঢাকা-২ আসনে এমপি হতে চেয়েছিলেন খেলাফত আন্দোলনের আমির আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জি। ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দলের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য কামরুল ইসলাম। এখানে আশ্বাস না পেয়ে আতাউল্লাহ হাফেজ্জি পরে প্রার্থী হয়েছেন মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে। তার মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে হেফাজত। তিনি সংগঠনটির সিনিয়র নায়েবে আমির।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে আলোচনায় আসা ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতার গুঞ্জন ছিল। কিন্তু জাতীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যেতে রাজি নয় তারা। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং বামধারার দলগুলোর সঙ্গেও এ দাবিতে সংলাপ করেছে ইসলামী আন্দোলন। দলের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, মীর জাফররা নির্বাচনে যাচ্ছে।

জামায়াত এবং হেফাজত সংশ্লিষ্ট দলগুলো গত এক দশকে নানা বাধাবিপত্তিতে পড়লেও ইসলামী আন্দোলন নির্বিঘ্নে সাংগঠনিক কাজ করেছে। দলটি ভোটের অংকে উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হওয়ায় বিএনপিও কাছে টানছে।

চরমোনাইয় পিরের দলের সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে অংশ নিয়ে কয়েকটি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ইসলামী আন্দোলন এক যুগে যে অবস্থান তৈরি করেছে, তা ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা ছিল। নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সমর্থন আরও বাড়বে।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে ভোটের অঙ্কে সবচেয়ে বড় জামায়াত। আদালতের রায়ে চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন হারানো দলটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে দলটির একজন নেতা দাবি করেছেন, নির্বাচনে অংশ নিলে হয়ত নিবন্ধন ফিরে পাওয়া যেতো। জামায়াত বেনামেও নির্বাচনে যাবে না বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।

সংগঠনের নেতা আতাউল্লাহ হাফেজ্জির নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেছেন, হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন। সাংগঠনিকভাবে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে নির্বাচনে জড়াবে না।

ধর্মভিত্তিক বাকি নিবন্ধিত দলগুলো সুফি এবং দরবার ঘরনার। জাকের পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, বিএসপি. ইসলামিক ফ্রন্ট এবং ইসলামী ফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এ দলগুলো আগে থেকেই সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত।