বিএনপির জন্য পাতা জালে আটকে গেছে আওয়ামী লীগ

বিএনপিকে বাইরে রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে যে জাল পেতেছিল আওয়ামী লীগ-দৃশ্যত মনে হচ্ছে তাতে তারাই আটকে গেছে।

বিএনপির প্রায় সব কেন্দ্রীয় নেতাকে কারাগারে রেখে,   তফসিল ঘোষণার পর নানা কৌশল-অপকৌশলের আশ্রয় নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ভাঙতে ব্যর্থ হয় তারা। এসব না পেরে কিংস পার্টি, ডামি, প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন জমাতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে এখন দেখা যাচ্ছে, নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে ভোটের মাঠে।

সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজের মতো করে ‌‘অ্যাবসলুট পাওয়ার ধরে রাখার’ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা নিজের জালেই আটকে যাচ্ছেন।

চূড়ান্ত মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন অর্থাৎ ৩০ নভেম্বরের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগকে নিজেদের সঙ্গে নিজেদের সংঘর্ষ, হামলায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে।

মনোনয় চূড়ান্ত করতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শরীক ১৪ দলের সঙ্গেও চলছে টানাপোড়েন। আর তাদের বিশ্বস্ত বিরোধী দল গোলাম মুহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে থাকা জাতীয় পার্টিকে আসন ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে আনলেও এখন চলছে স্নায়ুযুদ্ধ।

পিরোজপুর-১ আসনে (সদর, নাজিরপুর, জিয়ানগর উপজেলা) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান প্রাণীসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করীম। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় দলীয় নির্দেশে সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আউয়াল। রিটার্নিং অফিসারের বাছাইয়ে দু’জনের মনোনয়ন বৈধ হয়। ২ ডিসেম্বর দুই প্রার্থীই শোডউন করে। এ নিয়ে বাধে বিপত্তি। নৌকার মনোনয়ন পাওয়া শ ম রেজউল করীমের সমাবেশে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আউয়াল। তার সঙ্গে আছেন সিনিয়র সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান মালেকসহ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বড় একটি অংশ। এর প্রতিকার চেয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযোগও দেন শ ম রেজউল করীম। কিন্তু বিচারক পড়েন বেকায়দায়।

পরবর্তীতে এ অভিযোগকে কেন্দ্র করে সোমবার ৫ ডিসেম্বর বিকেলে জিয়ানগর উপজেলায় নৌকা সমর্থক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং হামলার ঘটনা ঘটে।

এ ছাড়া পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া উপজেলা) আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম। এ আসনে স্বতন্ত্র মনোনয়ন নিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজ। মনোনয়ন দাখিলের পর থেকেই দুই নেতার কর্মী-সমর্থকদের সাথে হাট-বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত অন্তত ১০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ দুই প্রার্থীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে; একে-অপরের কর্মী-সমর্থকের লাশ ফেলে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন বলে মঠবাড়িয়া থানায় সাধারণ ডায়েরিও হয়েছে।

ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার মনোনয় পেয়েছেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ। একই আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন শেখ হাসিনার আত্মীয় বর্তমান এমপি নিক্সন চৌধুরী। শুরু থেকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।

রাজশাহী-৩ (পবা, মোহরপুর উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার মনোনয়ন পান মোহাম্মদ আসাদুজ্জান আসাদ। আর দলীয় নির্দেশে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান এমপি আয়েন উদ্দিন। বুধবার সকালে মোহনপুর উপজেলার বাকশিমইল ইউনিয়নের সিন্দুরী গ্রামে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রাতীকের প্রার্থী আসাদের তিন কর্মীর হাত-পা ভেঙে দিয়েছে আয়েন উদ্দিনের কর্মীরা। আহতরা রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, হামলার পর আহতদের পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হয় এই বলে যে, নৌকার পক্ষে যে মাঠে নামবে, তাকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে।

পঞ্চগর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলার আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নঈমুজ্জামান ভূঁইয়া। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান এমপি মাজহারুল হক প্রধান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাতসহ চারজন। এ নিয়ে এ জেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বহুধারায় বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রতিনিয়ত বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি।

কুমিল্লার ১১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে আট আসনেই আওয়ামী লীগের শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। নওগাঁ জেলার ছয় আসনেই নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী আছেন। চট্টগ্রামের ১৬ আসনের মধ্যে ৭টি আসনেই নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রার্থী আছেন।

বরিশালেও চলছে টানাপোড়েন। জোটের শরীক ওয়ার্কাস পার্টির রাশেদ খান মেননকে বরিশাল-২ ও বরিশাল-৩ আসনে মনোনয়ন জমা দিতে বলা হলেও, বরিশাল-২ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি তালুকদার ইউনূস এবং বরিশাল-৩ এ জাতীয় পার্টির বর্তমান এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপুর মনোনয়ন বৈধতা পেয়েছে। তারা ভোটের মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন। এবং আসন ছাড় দিতে নারাজ।

কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদের হাসানুল হক ইনুর আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার কোনো প্রার্থী না থকলেও আওয়ামী লীগ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যে ইনুর বিরুদ্ধে ভোট করার ঘোষণা দিয়েছেন। 

যতদূর খবর পাওয়া গেছে, প্রতিনিয়ত এমন টানাপোড়েন চলছে অন্তত ১২ জেলায়। এসব জেলার ৩২ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপিরা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। এদের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। সাথে দলের সাবেক এমপিরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ নিয়ে কেন্দ্রে অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে প্রতিনিয়তই হামলা-মামলা হচ্ছে এবং আইনশৃঙ্থলা পরিস্থিতি হুমকিতে পড়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করেও কোনো সুরাহা হয়নি। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন ।

স্বতন্ত্র কয়েকজন প্রার্থীকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ডেকে কথাও বলেছে। তাদের সাফ জবাব, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। তাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক করতেই তারা প্রার্থী হয়েছেন। যে যেখান থেকেই মনোনয়ন নিক, ভোটের মাঠে লড়েই জিতে আসতে হবে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও তারাও আওয়ামী লীগের পদধারী দাবি করে বলেন, প্রার্থী হতে তাদের অনেক খরচ হয়েগেছে। এখান থেকে ফেরার উপায় নেই।

পরিস্থিতি এমন হওয়ার পেছনে শেখ হাসিনার একরোখা মনোভাবকে দায়ী করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মন্তব্য, বিরোধীদের জন্য পাতা জালে আটকে জড়িয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। এখান থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে। সেটা যত দ্রুত হবে, দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল হবে।